রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বাই-সেমিস্টার পদ্ধতিতে, অর্থাৎ বছরে দুইটি সেমিস্টার। কিন্তু শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় বছরে একবার। ফলে, কোনো শিক্ষার্থী যদি যেকোনো কারনে একবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারে তাকে প্রায় এক বছরের জন্য পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। অনুষদগুলোর অধ্যাদেশ অনুযায়ী ওই শিক্ষার্থীকে পরের ব্যাচের সাথে যুক্ত হয়ে সেমিস্টার সম্পন্ন করতে হবে। এতে কোন শিক্ষার্থীকে এক সেমিস্টারে কোনভাবে ফেল করলে ছাত্রজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি বছর।
বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বছরে দুই থেকে তিনবার ভর্তি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চিত্র ব্যতিক্রম। এখানে বছরে একবার ভর্তি নেওয়া হয়। ফলে, কোনো শিক্ষার্থী যদি যেকোনো কারনে একবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারে তবে তাকে প্রায় এক বছরের জন্য পিছিয়ে পড়তে হয়।
প্রায় এক দশক আগে থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের বিভাগগুলোতে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করা হয়। ধারাবাহিকভাবে গত বছর ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে সেমিস্টারে নির্ধারিত সময়ে ফলাফল প্রকাশ করতে না পারা ও বছরে একবার ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ায় তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, সেমিস্টার পদ্ধতিতে যাওয়ার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন ছিল সেটি উন্নতি করা যায়নি। অতি ব্যস্ততার সাথে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করতে গিয়ে আজকের এই জটিলতাগুলো দেখা দিয়েছে। অনেক শিক্ষকও সেমিস্টার পদ্ধতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। দূরদর্শীতার সাথে বিবেচনা করে এটি চালু করলে শিক্ষার্থীরা বিপদে পড়তো না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেমিস্টার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রকৌশল বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘অসুস্থতাজনিত কারনে আমি দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষায় বসতে পারিনি। এর ফলে আমার একটা সেমিস্টার লস হয়ে যায়। তবে কার্যত আমি এক বছর পিছিয়ে পড়েছি। পরের সেশনের সঙ্গে আমাকে ক্লাস পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করে কী লাভ যদি একজন শিক্ষার্থীর পুরো একটা বছর নষ্ট করে দেওয়া হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদগুলোর সেমিস্টার পদ্ধতির অধ্যাদেশ ঘেঁটে দেখা যায়, অনুষদগুলোর বিভাগ সমূহে ২ থেকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার নিয়ম। কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায় কোনো বিভাগেই দুই মাসের আগে ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও কোনো কোনো বিভাগে এ সময়টা ছয়মাস পার হয়ে যায়।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যায়, ৫৯টি বিভাগ ও স্নাতকে পাঠদান করানো ৪টি ইন্সটিটিউটের মধ্যে কোনো বিভাগই তাদের সর্বশেষ সেমিস্টারের ফল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করতে পারেনি। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর ক্লাস শুরু হওয়া ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রথম সেমিস্টারের ফলাফল প্রকাশ করতে পেরেছে ৪৫টি বিভাগ। ৬ থেকে ৮টি বিভাগ ফলাফল প্রকাশের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীরা চার মাসে সেমিস্টার শেষ করার দাবিতে বিভাগের তালা ঝুলিয়ে আন্দোলন করে। কারণ, ক্লাস শুরুর দশ মাস পার হলেও একটা সেমিস্টার শেষ করতে পারেনি তাদের বিভাগ। আবার এই মাসেই দুই দুইবার প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করেছে আইন অনুষদের শিক্ষার্থীরা। সেমিস্টারের ধীর গতির কারণে সেমিস্টার পদ্ধতি বাতিল করে ইয়ার পদ্ধতিতে যেতে চায় তারা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হতে আমাদের ছয় মাসের মতো সময় লেগেছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই ফলাফল দেওয়ার বিধান রয়েছে। ফলাফল প্রকাশে দেরি হওয়ায় আমরা পরের সেমিস্টার পরীক্ষায় বসতে পারিনি। ফলে অন্য বিভাগের চেয়ে আমরা প্রায় ছয় মাস পিছিয়ে পড়েছি।’
বিভিন্ন অনুষদের সেমিস্টার পদ্ধতির অধ্যাদেশ থেকে আরও জানা যায়, কলা অনুষদের প্রতিটি বিভাগের অভিন্ন নিয়মানুযায়ী ৪ ক্রেডিট অর্থাৎ ১০০ নম্বরের প্রতি কোর্সের জন্য ক্লাসের সংখ্যা ৬০টি (ক্রেডিট ঘণ্টা)। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৩ ক্রেডিট অর্থাৎ ১০০ নম্বরের একটা কোর্সের ক্লাস সংখ্যা ৪২টি (ক্রেডিট ঘণ্টা)। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে ক্লাস শেষ করতে হবে। ক্লাস শেষের পর দুই সপ্তাহ পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি সময় দিতে হবে এবং এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হবে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগই এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে না। অর্থাৎ সেমিস্টার পদ্ধতি হলেও বিভাগগুলো কার্যক্রম ইয়ারলি (বাৎসরিক) পদ্ধতির মতোই থেকে গেছে।
এ বিষয়ে ক্রপ সাইন্স এন্ড টেকনোলোজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, ‘বিভাগে শিক্ষক সংকটের ফলে একটি কোর্সের সবগুলো টপিকস নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হয় না। ফলে অধিকাংশ শিক্ষক ১০ থেকে ১৫টি ক্লাস নিয়েই তার কোর্স সম্পন্ন করে দেন। ফলে ওই বিষয়ের বিস্তারিত অনেক টপিকই আমাদের অজানা থেকে যায়। এছাড়াও অনেক শিক্ষক আবার বিভিন্ন কারনে নিয়মিত ক্লাস নিতে পারেন না। ক্লাস শেষ না হওয়ার ফলে আবার পরীক্ষা শুরু হতে দেরি হয়ে যায়।’
এ ছাড়াও অনুষদগুলোর অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোর্স মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সেমিস্টার ফাইনালের পাশাপাশি ইনকোর্স পরীক্ষা, ক্লাস উপস্থিতি, ল্যাবসহ বিভিন্ন পরীক্ষার উপরে নম্বর রয়েছে। ইনকোর্সের ক্ষেত্রে কোর্সের শিক্ষকরা টপিক অনুযায়ী ডিবেট, এসাইনমেন্ট, গ্রুপ ওয়ার্ক, ফিল্ড ওয়ার্ক, প্রেজেন্টেশনসহ ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির কথা কোর্স আউটলাইনে উল্লেখ থাকে। তবে, শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শিক্ষকেরা শুধুমাত্র নির্ধারিত কয়েকটি টপিকের উপরে একটা সেকেলে পদ্ধতির রচনা মূলক প্রশ্নোত্তরে সীমাবদ্ধ। ফলে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী কোনো দক্ষতাই অর্জন হচ্ছে না।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এগ্রোনমি এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের শিক্ষকেরা মোটামুটি ক্লাস ও ইনকোর্স পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। তবে আমাদের বিভাগে প্রাকটিকাল কাজ পর্যাপ্ত নয়। ফলে আমাদের শিক্ষায় একটা ঘাটতি থেকেই যায়। সেমিস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা চালু রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা শিক্ষার্থীদের সংখ্যার আনুপাতিক হারে বেশ ভালো থাকা জরুরি। তবে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত প্রায় এক দশক নিয়োগ বন্ধ থাকায় শিক্ষক সংকট রয়েছে চরমে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ভূমি প্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট যাত্রা শুরু করেছে প্রায় এক দশক আগে। এ তিন বিভাগে শিক্ষক রয়েছেন যথাক্রমে দুইজন, ছয়জন ও দশজন। তাদের কয়েকজনকে আবার অন্য বিভাগ থেকে এ বিভাগে সাময়িকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। একই চিত্র ইংরেজি, ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স, ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজম্যান্ট ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিসহ প্রায় ১০টির মতো বিভাগে। এছাড়াও প্রায় সকল বিভাগেই কম বেশি শিক্ষক সংকট রয়েছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রহমান রাজু বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তড়িঘড়ি করে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করতে গিয়ে আজকের এই জটিলতাগুলো দেখা দিয়েছে। দূরদর্শী ভাবনা ভেবে এটি চালু করলে ছাত্রছাত্রীরা বিপদে পড়তো না। এখন এগুলো থেকে উত্তরণ করতে হলে কিছু বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যেমন, প্রত্যেকটি বিভাগের পরীক্ষার ধরণ, ক্লাসের ধরণ সার্ভে করে বিশ্লেষণ করতে হবে যে, কতদিন ধরে পরীক্ষা দিলে বা ক্লাস দিলে নির্দিষ্ট সময়ে সব শেষ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্রীয়ভাবে এটা করতে হবে। পাশাপাশি, সেমিস্টার পদ্ধতিতে উন্নতির জন্য অনলাইন/অফলাইনে ক্লাস সমান্তরালভাবে চালু করতে হবে। তাহলে সবগুলো বিভাগের ক্লাস শুরু হবে একই তারিখে এবং শেষ হবে একই তারিখে। পরীক্ষা শুরু হবেও একই তারিখে। তবে পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগের সাঙ্গে সমন্বয় করে সিডিউল ফেলতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হচ্ছে তাদের একবছর লস হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এখানে অবশ্যই উচিত হবে, যেহেতু বছর শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার ভর্তি হয়, যারা অকৃতকার্য হচ্ছে তাদের জন্য একটি বিশেষ পরীক্ষা কমিটি করে এক থেকে দুই মাসের মধ্যে তাদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। যাতে তাদের বছর লস না হয়।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘একাডেমিক কাজগুলো আরও গতিশীলতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে আমরা শীঘ্রই কাজ শুরু করবো। দীর্ঘদিনের চর্চা থেকে সংস্কারে আসতে কিছুটা সময় লাগছে। ইতিমধ্যে আমরা আইকিউএসির সদস্যদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। নতুন যারা কাজ শুরু করেছে তাদেরকে সংস্কারের চর্চা শুধু খাতা কলমে না বরং শ্রেনিকক্ষে যেন থাকে সে বিষয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা চলতি মাসেই আরেকবার তাদের সঙ্গে বসবো।
শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ড্রপের ফলে অতিরিক্ত ছয়মাস নষ্টের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘একজন ছাত্রের জীবন থেকে ছয়মাস নষ্ট হওয়া ব্যাপক ক্ষতি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে একবার ছাত্র ভর্তি করি। ফলে সেমিস্টার পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময়ের একটা অসঙ্গতি থেকে যায়। আমরা নিজেদের শুধু এই বিষয়টি সমাধান করা সম্ভব না। এটা নিয়ে সামগ্রিকভাবে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে চিন্তা করতে হবে।’
এসএস
আপনার মতামত লিখুন :