ঢাকা : পৌষের শুরুতে তেমন একটা ঠান্ডা না থাকলেও মাসের শেষ দিকে এসে জেঁকে বসেছে শীত। রাত হলে ঘন কুয়াশা আর দিনের বেলা হিমেল বাতাসে কাহিল হয়ে পড়েছে জনজীবন।
আবহাওয়ার এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। এ ছাড়া ঠান্ডায় শিশু ও বৃদ্ধরা নিউমোনিয়াসহ শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলেছে, শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে কিশোরগঞ্জের নিকলি এবং চুয়াডাঙ্গা জেলায়।
চুয়াডাঙ্গা : মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। হাড়কাঁপানো শীতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বাইরে বের হচ্ছে না মানুষ। তবে পেটের দায়ে অনেককে বাইরে বের হতে দেখা গেছে।
শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) সকালে শীতের মধ্যেই শহরের রাস্তায় যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন সদর উপজেলার ঝোড়াঘাটা গ্রামের বাসিন্দা ভ্যানচালক কোরবান আলী।
তিনি বলেন, খুব সকালে বাজারে এসেছি। রাস্তাঘাটে কোনো লোকজন ছিল না। এখন কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। বাতাস হচ্ছে, এজন্য কেউ খোলা ভ্যানে উঠতে চাচ্ছে না। সবাই ইজিবাইকে চড়ে চলে যাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গার বুজরুকগড়গড়ি গ্রামের কৃষক ইয়াসিন উদ্দিন বলেন, এবার ডিসেম্বরে অন্য বছরের তুলনায় শীত কম ছিল। তবে, কুয়াশা ছিল। কিন্তু জানুয়ারিতে শীত জেঁকে বসেছে। কুয়াশাও বেড়েছে। ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
শীতজনিত রোগীদের চাপ বেড়েছে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালসহ জেলার চার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। শিশুদের নিউমোনিয়া আর বড়দের শ্বাসকষ্ট জনিত নানা সমস্য নিয়ে প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগে ভিড় করছে রোগীরা।
সদর উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের নুরজাহান তার শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন। তিনি জানান, তার এক বছর বয়সি মেয়ের ঠান্ডা কাশি ভাল হচ্ছে না। চিকিৎসা চলছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আসাদুর রহমান খোকন বলেন, শিশুদের ব্যাপারে শীতে খুব সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ভাবেই তাদের যাতে বেশি ঠান্ডা কিংবা গরম না লাগে। কোনো কারণে শিশু অসুস্থ হলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আমরা লক্ষ্য করেছি, বেশিরভাগ অসুস্থ শিশুদের দেরি করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। তখন সুস্থ হতে বেশ সময় লেগে যায়।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক তহমিনা নাছরিন জানান, শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় চুয়াডাঙ্গার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস; যা মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।
কুড়িগ্রাম : তিন দিন ধরে কুড়িগ্রামে সূর্যের দেখা নেই। ঘন কুয়াশা আর হিম বাতাসে কাজে বের হতে পারছেন না শ্রমজীবীরা। রাস্তায় লোক চলাচল কমে গেছে। এদিকে কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাসের কারণে বোরো বীজতলার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষি।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র জানান, শুক্রবার সকাল ৬টায় কুড়িগ্রামে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
জেলার ১৬টি নদ-নদী তীরবর্তী এলাকা এবং চরাঞ্চলে হিমেল বাতাসের কারণে জবুথবু হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। অনেকেই খড়কুটো জ্বালিয়ে উত্তাপ নিতে দেখা গেছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার চর সিতাইঝার এলাকার কৃষক আব্দুল বাতেন বলেন, কৃষি শ্রমিকরা হিম ঠান্ডার কারণে কাজে বের হতে পারছেন না। ফলে বোরো চাষের জন্য জমি তৈরি ও সবজি ক্ষেত পরিচর্যা করতে পারছেন না কৃষক।
কাঠালবাড়ির কৃষক বাদশা মিয়া বলেন, কুয়াশা বেশি হওয়ায় আলুর ক্ষতি হচ্ছে। ‘লেট ব্লাইটের’ আক্রমণ ঠেকাতে ক্ষেতে ঘন ঘন ওষুধ স্প্রে করতে হচ্ছে।
শীতার্থদের মাঝে এখন পর্যন্ত ৩৮ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে; যা চাহিদার তুলনায় খুবি কম বলে জানিয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পূণর্বাস কর্মকর্তা আব্দুল হাই।
মেহেরপুর : মেহেরপুরে দুপুর পর্যন্ত সূর্যের দেখা মেলেনি। শহরের দোকানপাট খোলেনি। শুধুমাত্র চায়ের দোকানে জবুথবু হয়ে কিছু মানুষের জটলা। হালকা দু-চারটা রিকশা রাস্তায় চলাচল করতে দেখা গেলেও যাত্রী নেই।
শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) মেহেরপুরের তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে; যা চলতি মৌসুমে সর্বনিম্ন বলে জানিয়েছেন জেলা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা শাহ নেওয়াজ ফরিদ।
শহরের হোটেল বাজার মোড়ে কথা হয় রিকশাচালক জুবায়ের উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তিনি বলেন, শীতের শুরু থেকেই রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কমে গেছে। তাই আয়ও কমেছে। প্রতিদিন যেখানে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হয়। সেখানে এই শীতে ২০০ টাকা আয় হয় না।
শীতে আয় কমলেও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমেনি। তাই স্বল্প আয়ে ৫ থেকে ৭ জনের সংসারে নুন-ভাত খাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।
সদর উপজেলার চকশ্যামনগর গ্রামের দিনমজুর জাফর হোসেন (৬৫) প্রায় ১০ বছর ধরে শহরের হোটেল বাজারে শ্রম বিক্রি করে আসছেন। এখানে খুব সকালে শ্রমিকরা কাজ পেয়ে যান। কিন্তু দুপুর গড়ালেও তিনি শ্রম বিক্রির সন্ধান পাননি। তাই পরদিন সংসার চলবে কীভাবে এই দুশ্চিন্তা তাকে ভর করেছে।
তিনি বলেন, শীত দীর্ঘস্থায়ী হলে জমিতে চাষাবাদ কমে যায়। তাই আমাদের মত প্রতিদিন খেটে খাওয়া মানুষের কর্ম ও আয় কমে যায়।
বন্ধ দোকানের সামনে বসে আছে ১৬ বছরের হেলাল। সে বলে, বাজারে ক্রেতা কম থাকায় মালিক আজ মুদী দোকান খুলবেন না। দিন হাজিরায় চাকরি করি। দোকান না খুললে বেতন পাব না। আজ কীভাবে চাল কিনে নিয়ে বাড়ি যাব?
এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে সকালে পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহনকে হেড লাইট জ্বালিয়ে সড়কে চলাচল করতে দেখা গেছে।
হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক আবু ইউসুফ সবুজ।
তিনি বলেন, ভর্তি হওয়া রোগীদের বেশিরভাগই নিউমোনিয়া, হাঁপানি, ডায়রিয়া, ঠান্ডা-কাশি, জ্বরে আক্রান্ত। চিকিৎসক সংকট থাকায় রোগীদের সেবা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে।
পাবনা: পাবনায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত বৃষ্টির মতো শিশির ঝরেছে। শুক্রবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত জেলার কোথাও সূর্যের দেখা মেলেনি। গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।
ঈশ্বরদীতে সকালে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস; এটি মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে জানিয়েছেন ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ নাজমুল হাসান।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে তাপমাত্রা প্রায় কাছাকাছি রয়েছে। এ জন্য ঠান্ডা বেশি অনুভূত হচ্ছে।
এদিকে সকাল থেকে শহরের পুরান কাপড়ের বাজারে গরম পোশাকের দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা। পাশাপাশি বাজারের বিভিন্ন শপিং মল ও বিপণী বিতানেও এসব পোশাক বিক্রি বেড়েছে।
কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জের নিকলী আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক আখতার ফারুক জানান, নিকলীতে তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে; যা দেশের সর্বনিম্ন।
শুক্রবারের তুলনায় শনিবার শীত সামান্য বাড়বে; এ মাসজুড়েই শীত থাকবে বলে জানান তিনি।
শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ অব্যাহত রয়েছে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ।
এমটিআই