ঢাকা : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশেও আবহাওয়ার চরম রূপ দেখা যাচ্ছে ঋতুতে ঋতুতে। উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো শীতের সময় তীব্র শৈত্যপ্রবাহে এবং গরমকালে তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে পড়ছে। ভৌগোলিক কারণের পাশাপাশি নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও জলাধার লোপাট করার ফলে দেখা দিচ্ছে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া। বিশেষ বিশেষ এলাকায় খরা দেখা দিচ্ছে; মরুকরণ প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার ব্যাপ্তি বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে কয়েক দশকের মধ্যে লবণাক্ততার বিস্তৃতি মধ্যাঞ্চলেও পৌঁছার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বায়ুর গতিপথ বদলাচ্ছে। মরূকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সুপেয় পানির সংকটসহ কৃষিতেও বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতেই বুধবার (৫ জুন) পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য : ‘করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা, অর্জন করতে হবে মোদের খরাসহনশীলতা’।
জাতিসংঘের আইপিসিসির এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক দশকে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ দশমিক ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালনাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও শূন্য দশমিক ৫০ থেকে ১ দশমিক ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। বাংলাদেশ মেটেরিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (বিএমডি) রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের গড় তাপমাত্রা গত ৫০ বছরে প্রায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
তাপমাত্রা বাড়ার কারণ সম্পর্কে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা, পরিবেশবিষয়ক অব্যবস্থাপনা এবং নির্বিচারে বৃক্ষনিধন দায়ী। বনভূমি কেটে ফেলার কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেছে, এটা তাপমাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণ। এই গ্যাসগুলো সৌরবিকিরণ শোষণ করে এবং তা আবার বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়, ফলে তাপমাত্রা বাড়ে।’
তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বাতাস শুষ্ক হয়ে পড়ছে, ভূ-উপরিস্থ স্বাদুপানির আধার কমছে। ইতিমধ্যে দেশে অনেক জলাশয় বিলীন হয়ে গেছে। ক্রমেই নাব্য হারাচ্ছে নদীগুলো। ফলে খরার প্রকোপও বেড়েছে।
বিশেষ করে নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও জেলা উচ্চমাত্রার খরাঝুঁকিতে রয়েছে। খরার কারণে প্রতি বছর এই অঞ্চলে প্রায় ২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি খরার প্রভাবে ইতিমধ্যে উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে লবণপানি। সুন্দরবন উপকূলে ৭৩ শতাংশ পরিবার সুপেয় পানি পাচ্ছে না। ১২ বছরে উপকূলীয় অঞ্চলে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ। ৩৫ বছরে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েছে ২৬ ভাগ, যার পরিমাণ ২ পিপিটি থেকে বেড়ে ৭ পিপিটিতে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে কৃষি খাতে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সালে এমন বাড়বে যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রগর্ভে লীন হয়ে যাবে।
কৃষিতে বাড়ছে ক্ষতি : এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৫০ বছরে বাংলাদেশ প্রায় ২০ বার খরাকবলিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে। সে সময় দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ আবাদি জমি ক্ষতির শিকার হয়েছিল। ১৯৯৪-৯৬ সাল পর্যন্ত খরার কারণে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান কৃষি ফসল ধান ও পাট মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এরপরও বিভিন্ন সময়ে খরা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে কৃষিতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ কোটি ডলার।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ও রোগতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, ‘খরায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চল। কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছি নাটোর, রাজশাহীসহ কিছু এলাকায় পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নেমে যাচ্ছে। এ এলাকাগুলোয় ফসল হতো না, তাই আমবাগান। এখন দেখা যাচ্ছে আমের বাগানও হুমকির মুখে পড়েছে। পানি পাচ্ছে না। খরার প্রভাব কৃষিতে পড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে তাপমাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে। ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। খরার প্রবণতা বাড়ছে। খরার কারণে আমরা ফসল উৎপাদনের ধরন পরিবর্তন করেছি। এক ফসল থেকে অন্য ফসলে গিয়েছি। এই ফসলগুলোও এখন সংকটে পড়েছে। টেকসই সমাধান হচ্ছে না। সমস্যার প্রকটতা বাড়ছে।’
নদীর গতিপথ পরিবর্তন, উজান থেকে পানি প্রত্যাহার খরার বড় কারণ বলে মনে করেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভুল ম্যানেজমেন্টের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রথমত, মরুকরণ হয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চলে ও গঙ্গা অববাহিকায়। এ দুটো জায়গায় পানি কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, নদীগুলোর পানি ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে বিভিন্ন নদী শুকিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে কৃষিকাজ হয় না। আন্তঃসীমান্ত পানি আনার ক্ষেত্রেও সঠিকভাবে সমঝোতা করতে পারছি না। ওপরের পানি আসে না, আবার নিচের যতটুকু পানি আসে, তাতে ভুল ব্যবস্থাপনা। জলাধার ভরাট করে ফেলছি। প্রাকৃতিকভাবে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা কমে যাচ্ছে। ফলে মরূকরণ স্বাভাবিক।’
জলবায়ুবিশেষজ্ঞ ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, ‘গত কয়েক বছরে তাপপ্রবাহ বেড়েছে। তাপপ্রবাহে জলাশয় শুকিয়ে যায়, সেচ ব্যবস্থাপনা বন্ধ হয়ে যায়, মাটির আর্দ্রতা নষ্ট হয়ে যায়; সব মিলিয়ে খরাপ্রবণ অবস্থা তৈরি হয়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং যে স্কেলে চলছে এবং গাছপালা-জলাশয়-সবুজ ধ্বংস হচ্ছে, অপরিকল্পিত অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে; এরও প্রভাব আছে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যবস্থাপনার ঘাটতি দূর করতে হবে। জলাশয়, নদী দখল-দূষণমুক্ত করতে হবে এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থাপনা কিন্তু আমাদের দেশের জন্য নেই। আমরা একটা সময় ভালো বৃষ্টিপাত পাই।
আমাদের প্রচুর নদী, খাল আছে, জলাশয় আছে, পুকুর আছে, রাজশাহী অঞ্চলে চলনবিল আছে। যদি এগুলোর উন্নয়ন কার্যক্রম নেওয়া হয়, তাহলে পরিবেশের কথা মাথায় রেখে যেন নেওয়া হয়।
এগুলো আমরা সৃষ্টি করিনি, প্রকৃতি তার নিজস্ব প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছে। খরাপ্রবণ অঞ্চলের নদীগুলোর পানির ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ যেন গুরুত্ব দিয়ে করা হয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে কোথায় কী ঝুঁকি দেখা দিতে পারে, সে বিষয়ে গবেষণা করে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।’
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :