“আমি একা এই পৃথিবীকে বদলে দিতে পারবোনা। তবে আমি স্বচ্ছ জলে একটি ছোট পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করে বড় বড় জলতরঙ্গ সৃষ্টি করতে পারবো।’
এরকম নিছক একটি বাণী বলে যাননি, করেও দেখিয়েছেন। আমৃত্যু আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সারাবিশ্বের মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন তিনি। মাদার তেরেসা নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে নীল পাড়ের সাদা রঙ্গের এক বিশেষ পোশাক পরিহিত সংকীর্ণ শরীরের এক বৃদ্ধাকে। যার কোটরের ভেতরে থাকা ঘোলাটে চোখ সবসময় উজ্জ্বল করছে। তাকে দেখে একবারও মনে হবে না তিনি বয়স নুয়ে গেছেন বরং মনে হতে পারে আপনার, ক্লান্ত হয়েছেন কাজের ভারে।
সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা অবহেলিত অনাথ, মাদার তেরেসা তাদেরই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সাধারণ থেকে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। যার একমাত্র পেশা এবং ধর্ম ছিলো মানবসেবা। আজ মহীয়সী নারীর প্রয়াণ দিবস। তিনি ১৯৯৭ সালের এই দিনে তিনি মারা যান। তার পারিবারিক নাম ছিলো অ্যাগনিস গঞ্জা বোজাঝিউ।
তিনি ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন আলবেনিয়ায়। বংশগত ভাবে আলবেনীয় হলেও মূলত তিনি ছিলেন ভারতীয় ক্যাথেলিক। তিনি ছিলেন নিকোলো ও দ্রানা বয়াজু দম্পতির কনিষ্ঠ সন্তান। বাবা ছিলেন আলবেনীয় রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯১১ সালে মাত্র আট বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে হারান।
মাদার তেরেসার বাবা আলবেনিয়ার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কিশোরী তেরেসা কখনোই তার বাবার পেশা দ্বারা প্রভাবিত হননি। বাবার মৃত্যুর পর তার মা ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। এবং এর আদর্শে লালন পালন শুরু করেন।
তখন তিনি এতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যার ফলাফল চার বছর পরেই ধর্মীয়ভাবে সন্ন্যাসী হয়ে জীবন যাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ১২ বছর।
তবে তিনি শুধু ক্যাথলিক বা খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে কাজ করেন নি। তার উদ্দেশ্য ছিলো মানবসেবা। এখানে তিনি কোন ধর্মকেই ভেদাভেদ করেননি। আঠারো বছর বয়সে গৃহ ত্যাগ করে তেরেসা সিস্টার্স অব লেরোটা নামের একটি সংস্থায় মিশনারি হিসেবে যোগ দেন। আপনা জানলে অবাক হবেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা অথবা বোনের সাঙ্গে তার কখনোই দেখা হয়নি।
সংস্থাটি এক বছর পরেই তাকে ভারতে পাঠা ধর্মসেবার কাজে। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় কনভেন্ট স্কুলে পড়ানোর সময় চূড়ান্তভাবে তেরেসা সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন। স্কুলে পড়াতে তার ভাল লাগলেও পঞ্চাশ দশকের সময় কলকাতা শহরের দারিদ্র্যে, দুঃখ এবং মৃত্যু তাকে বিচলিত করে তোলে অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাকে ভাবায়। তিনি ১৯৪৮ সালের ১৭ আগস্ট কনভেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য হাত পাতেন দ্বারে দ্বারে।
দুস্থ মানুষকে সাহায্য করার কাজটি যেন তার কাছে নেশার মতো হয়ে যায়। তিনি যখন লরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন, তখন তার হাতে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। এ রকম নিঃস্ব অবস্থাতেই তিনি স্কুলের সাজানো ফুলের বাগান, স্নিগ্ধ পরিবেশ, সুখময় নিশ্চিন্ত জীবন ফেলে এসে আশ্রয় নিলেন শিয়ালদহ রেলস্টেশন-সংলগ্ন এক পুরনো ভাঙাবাড়িতে। কলকাতার অলিগলি আর বস্তিতে ঘুরে বেড়াতে থাকেন, উদ্দেশ্য অসহায় মানুষের সেবা করা।
১২ জন সদস্য নিয়ে ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিট’। যার শাখা বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে। ১৯৫২ সালে এই চ্যারিটির অধীনেই গড়ে উঠে ‘নির্মল হৃদয়’, কুষ্ঠ রোগীদের জন্য ‘শান্তি নগর’। ১৯৫৫ সালে স্থাপন মাদার তেরেসা স্থাপন করেন ‘নির্মল শিশুভবন’। ১৯৬৩ সালে গড়ে তোলা হয় ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-এর ব্রাদার শাখা।
মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল সময়ের ব্যবধানে তা কয়েক হাজারে পৌঁছায়। তারা সবাই বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪৫০টি সেবা কেন্দ্রে মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছিল। ভারতের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের দুঃস্থ মানুষদের সেবা করার জন্য ভারতের বাইরে প্রথমবারের মতো ১৯৬৫ সালে ভেনিজুয়েলায় মিশনারি অব চ্যারিটির শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৬৮ সালে রোম, তানজানিয়া এবং অস্ট্রিয়াতে শাখা খোলা হয়। ১৯৭০-এর দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েক ডজন দেশে শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাদার তেরেসা ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত।
সব বাঁধা পেরিয়ে গড়ে তোলেন মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত। সবচেয়ে যারা গরিব, সবচেয়ে করুণ যাদের জীবন- তাদের সেবা করাই ছিল মাদার তেরেসার ব্রত।
তিনি জীবনে বিভিন্ন সরকার ও প্রতিষ্ঠান থেকে বহু পুরস্কার পেলেও এ নিয়ে তার কোনো গর্ব ছিল না বরং তিনি পুরস্কার হাতে নিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বলতেন, ‘আমি অতি ক্ষুদ্র। আমার শক্তি আমার কর্মবাহিনী আর জনগণের ভালোবাসা। এ পুরস্কার তো তাদের প্রাপ্য।’
ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। দুস্থ মানবতার সেবায় আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। জাতিসংঘ মাদার তেরেসার গড়া মিশনারি অব চ্যারিটি সংগঠনটিকে সম্মাননা জানাতে প্রচলন করেছিল, সেরেস মেডেল। মাদার তেরেসার সবচেয়ে বড় অর্জন, তার দেখিয়ে দেওয়া আদর্শ। তার আদর্শ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ‘মিশনারিস অব চ্যারিটি’ এর লাখো সিস্টার মানবসেবায় এখনও নিয়োজিত আছেন।
আপনার মতামত লিখুন :