‘সবে তো এই বর্ষা গেল শরত এলো মাত্র
এরই মধ্যে শুভ্র কাশে ভরলো তোমার গাত্র।’
ঝুম বর্ষার ক্লান্তিতে মাতাল মেঘ যখন এদিক-ওদিন উড়া-উড়ি করে বিদায়ের ধ্বনি তোলে তখন মাটি ফুড়ে জলাভূমি, চরাঞ্চলে শুভ্র কাশের ঝাড় রাঙ্গায় শরতের আকাশ। ঠিক যেনো কবি নির্মলেন্দু গুনের ‘কাশফুলের কাব্য’ কবিতার রমণীর মতো।
নদীমাতৃক এই দেশের বাহারি রূপের তৃতীয় ঋতুতে দেখা মেলে কাশ ফুল। বাঙ্গালির চিত্তে তখন শান্তির বাতাস হু হু করে ঢেউ খেলে সাদা মেঘের আদলে। যেনো কোমর দুলানো নববধূর আঁচল। সে আঁচল নদীর তীর ধরে সুখবর নিয়ে হেঁটে যায় শহর থেকে গ্রামান্তরে। যত দূর দেখা যায় চোখ জুড়ানো নরম পালকের কমলতা এসে জাপটে ধরে প্রকৃতি প্রেমিদের। তারা হয়ে ওঠে ভাবুক, কবি, লেখক, কথাসাহিত্যিক, শিল্পী।
প্রকৃতির রানি যেমন নিজেকে সাজাতে অঙ্গে ধারণ করে শিউলি, বেলি, দোলনচাঁপা, বকুল, পদ্ম, কেয়া, মাধবী, মল্লিকা, মালতী, হিমঝুরি, গগনশিরীষ, ছাতিম, পাখিফুল, পান্থপাদপ, বকফুল, মিনজিরি, শেফালিসহ নানা অলঙ্করণ। তারাও যায় পেয়ে উপকরণ নিজের বাড়বাড়ন্ত কল্পনার ক্যানভাসে চিত্র আঁকতে।
শুধু কি তাই ! হাওড়-বাওরে, বিলে-ঝিলে স্বচ্ছ জলরাশির ওপর ভেসে বেড়ানো নীল আকাশ ও পূর্ণিমার ঝিলমিল জ্যোৎস্না আপনাকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে বাধ্য করবে প্রকৃতি। এই সময়ে রাতের কান্নায় ভিজে ওঠে দূর্বাঘাসের ডগা। ভোরের অপরূপ সৌন্দর্যে উপচে পড়ে শীতের আগমীবার্তা।
বাংলা সাহিত্যের নদী-নালা, খাল-বিলে পুঁটি, চান্দা, খলসে মাছের মতো শরত এবং কাশফুল নিখুঁত আলপনা এঁকে আসছে আদিকাল থেকে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছেন-
‘আজি কি তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শরৎ প্রভাতে
হে মাতা বঙ্গ-শ্যামল অঙ্গ
ঝরিছে অনল শোভাতে...’।
লিখেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার অসংখ্য গান, কবিতায়। ‘রাখীবন্ধন’ পড়লে শরতের লাবণ্যময় এসে ধরা দিবে আপনার চোখে। সই পাতানো কোনও গল্পের খোঁজও পেয়ে যেতে পারে আকাশ, নদী ও ফুলের। তিনি লিখেছেন-
‘সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণী?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণী!
অলকার পানে বলাকা ছুটিছে, মেঘ-দূত- মন মোহিয়া!
চঞ্চুতে রাঙ্গা কল মীর কুঁড়ি- মরতের ভেট বহিয়া!
সখীর গাঁয়ের সেঁউতি- বোঁটার ফিরোজায় রেঙ্গে পেশোয়াজ
আসমানী আর মৃন্ময়ী সখী মিশিয়াছে মেঠো পথ- মাঝ!’
অন্যদিকে শরতের মুগ্ধতায় কেউ কেউ স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন। কাশফুলের বিস্তীর্ণ মোহে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজতে থাকেন প্রকৃতির মাঝে। এই যেমন কবি জীবনান্দ দাস তার ‘একদিন খুঁজেছিনু যারে’ কবিতায় লিখেছেন-
‘একদিন খুঁজেছিনু যারে
বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,
মালতীলতার বনে,- কদমের তলে,
নিঝুম ঘুমের ঘাটে,-কেয়াফুল,- শেফালীর দলে!
-যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে...’
শরৎ শুধু কাশফুল বা শিউলির নয় উৎসবেরও ঋতু। শিউলির ভেজা গন্ধে দেবী দুর্গার আগমনের ইঙ্গিত দিতে থাকে অন্য দিকে ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মীরও। কিছুদিন পরই রাতের আকাশে আতশবাজির ঝলকানিতে জেগে ওঠে দীপাবলি উৎসব।
শরতের এ সময়ে গ্রামীণ নব বধূরা লাল-সাদা মিছিলে নাইওর যায় বা বাবার বাড়িতে যায়। উত্তরবঙ্গে বসে ভাদর কাটানির উৎসব। আমন ধানের সবুজ চারার ওপর ভোরের হিমেল ঢেউ খেলে। এ সময় কৃষকরা নবান্নের অপেক্ষায় দিন গোনে।
শরৎ মানেই রূপসী প্রকৃতির ঐকতানের সুর। নীল, সাদা, আকাশি, ধূসর কিংবা সবুজ বউলের নাচ। শরৎ মানেই রমণীর উচাটন মনের স্নিগ্ধ কোলাহল। শুভ্রতার জ্যোৎস্নায় ভাসা বিরহী রাত
আপনার মতামত লিখুন :