সিরাজগঞ্জ: দেশের বৃহত্তম জলাভূমি চলনবিলে সেই থইথই পানি আর নেই। কমে গেছে মাছের উৎপাদনও। এই মৎস্য ভাণ্ডার ঘিরে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা শুঁটকি পল্লীতেও পড়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। থাবা গেড়েছে শুঁটকি ব্যবসাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটও।
মৎস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিল অঞ্চলে আবহাওয়া জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় শুঁটকির উপযোগী দেশিয় মাছের আকাল পড়েছে প্রায় ১৬০টি শুঁটকি তৈরির চাতালে। এতে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছেন শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, অতীতে চলনবিল অঞ্চলের নয়টি উপজেলার বিভিন্ন অংশে বর্ষা মৌসুমে প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ মাস তিন থেকে আট ফুট পর্যন্ত পানি থাকতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবহাওয়া জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে চলনবিল অঞ্চলেও পানির পরিমান ও পানি থাকার আয়ুকাল কমে এসেছে। এ বছর শেষ আষাঢ়ে চলনবিলের বিভিন্ন অংশে মাঝারি মানের স্বল্প সময়ের জন্য বন্যা দেখা মিলেছিল, যা দেড় মাসের মত স্থায়ী ছিল। আর ভাদ্র মাসের শেষে এক কালের প্রবাহমান জলের জন্য বিখ্যাত চলনবিলের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, গুরুদাসপুর, সিংড়া, আত্রাই এলাকার বিভিন্ন অংশ থেকে পানি একেবারে নেমে গেছে। এ কারণে দেশিয় প্রজাতির শুঁটকি করা হয় এমন পুটি, ট্যাংরা, টাকি, মাঝারী আকারের বোয়াল, শোল, চান্দা, গুচি, ছোট আকারের ইছা বা চিংড়িসহ কোন মাছই চাহিদা মতো পাওয়া যাচ্ছে না। যাও বা পাওয়া যাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। পাশাপাশি দামও অনেক বেশি।
সরেজমিনে চলনবিলের শুঁটকি পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, শুঁটকি তৈরির উপযোগী দেশিয় প্রজাতির মাছের বড় উৎস তাড়াশের মহিষলুটি, মান্নান নগর, সিংড়ারদহ, সলঙ্গাসহ বড় আকারের মাছের আড়তগুলোতে চাষ করা মাছে ঠাসা। এ সকল মাছের আড়তে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় কোটি টাকার মাছ বিক্রি হলেও দেশিয় প্রজাতির বিলের মাছের আমদানি খুবই কম।
অবশ্য, তাড়াশ উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে পুরো শুঁটকি তৈরির মৌসুমে শুধু তাড়াশ উপজেলা এলাকায় থাকা শুঁটকির চাতালে প্রায় ৩০০ টন দেশিয় মাছের শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল। অথচ এ বছর বড় ও মাঝারি আকারের শুঁটকির চাতালগুলো মাছের অভাবে অলস পড়ে আছে। এটাই বাস্তবতা বলে মন্তব্য করেন আরেক চাতাল মালিক মাহফুজ আহমেদ। তবে যখন খাল, নয়নজুলি, নালা, ডোবা শুকিয়ে মাছ ধরা শুরু হবে তখন শুঁটকি তৈরির উপযোগী কিছু মাছ পাওয়া যাবে সে ভরসায় আছেন চাতাল মালিক ও শ্রমিকরা।
দেশিয় প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরি চাতাল মালিক তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ গ্রামের বাসিন্দা মো. ফরিদুল হক (৬১) জানান, প্রায় দেড় দশক যাবত চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশ উপজেলা এলাকার মহিষলুটিতে শুঁটকি তৈরি চাতাল করে শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুমী ব্যবসা করেন তিনি। তাঁর চাতালে এলাকার প্রায় ২০ থেকে ২২ জন নারী শ্রমিক এ কাজে নিয়োজিত থাকতেন তিন থেকে সাড়ে তিন মাস। এ সকল শ্রমিক দিন হাজিরায় পারিশ্রমিক পেতেন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আর মৌসুমী এ কাজের আয় দিয়ে শুঁটকির উৎপাদন ব্যায়, চাতাল শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিয়ে অবশিষ্ট আয়ে সারা বছর তিনি নিজের সংসার চালান অনায়াসে। কিন্তু চলতি বছর দেশিয় প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরির এ ভরা মৌসুমে মাছের আকালে অলস পড়ে আছে চলনবিলাঞ্চলের প্রায় ১৩০ থেকে ১৫০ টি শুঁটকি তৈরির চাতালের অধিকাংশ।
অপর দিকে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর এলাকার শুঁটকি চাতাল মালিক আবু তালেব জানান, ভাদ্র মাসেও চাতালে শুঁটকি উৎপাদন তেমনটি শুরু করতে পারেনি চলনবিল অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অধিকাংশ শুঁটকির চাতাল। ছোট আকারের কিছু শুঁটকি চাতাল চালু থাকলেও তাঁদের অবস্থাও নাজুক। আর চলনবিলের দেশিয় প্রজাতির শুঁটকি তৈরির মাছের উপরই এ শুঁটকির চাতাল মালিকরা নির্ভরশীল। যার আর কোন বিকল্প নেই।
এ প্রসঙ্গে তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মশগুল আজাদ বলেন, চলনবিল অঞ্চলটা বড় এলাকা। আর এ বছর বিলের পানি আগে ভাগেই নেমে গেছে, তাই বিলের দেশিয় মাছের উৎস মুখটা থেকে শুঁটকি তৈরির বেশি মাছ পাওয়ার ক্ষেত্রেও কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে। তবে চলনবিলে এখনও অনেক খাল, নালা, নয়নজুলি, ডোবা আছে। আর সেখানেও প্রচুর মাছ থাকে। তাই ওই সকল খাল, নালা, ডোবা শুকিয়ে মাছ ধরা শুরু হলেই তখন শুঁটকি তৈরির উপযোগী মাছের তেমন অভাব হওয়ার কথা নয়।
এসএস