ঢাকা: ঢাকা নগরীর শত বছরের ইতিহাসের এক বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে এর আনাচে-কানাচে এখনও টিকে থাকা মন্দিরগুলো। একই সঙ্গে স্থাপনাগুলো তৎকালীন সময়ের স্থাপত্যশৈলীর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অধিকাংশগুলোতে এখনও পালিত হয় ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান। চলুন, ঢাকা ও নিকটবর্তী এলাকার এমনি ৫টি মন্দির সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির
ঢাকার পলাশী এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বৃহত্তম এই উপাসনালয়টি ঢাকার প্রথম হিন্দু মন্দির। এর গোড়াপত্তন হয় সেন রাজবংশের সম্রাট বল্লাল সেনের হাতে ১,২০০ শতকে। কথিত আছে যে, বল্লাল সেনের জন্ম হয় বুড়িগঙ্গার এক জঙ্গলে। সেখানে বেড়ে ওঠার সময় একদা তিনি এক দুর্গা মূর্তি পান। তার বিশ্বাস ছিল যে, জঙ্গলের যাবতীয় বিপদ থেকে তাকে রক্ষার পেছনে রয়েছে এই দেবী। পরবর্তীতে রাজ ক্ষমতায় বসার পর বল্লাল সেন এই স্থানে একটি মন্দির স্থাপন করেন। বনের ভেতর আবৃত অবস্থায় ছিল বলে এই দেবীকে ডাকা হতো “ঢাকেশ্বরী” তথা “ঢাকা ঈশ্বরী”। অতঃপর মন্দিরটিও এই নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে।কয়েকটি মন্দির ও সৌধের সমন্বয়ে গঠিত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মূল ভবনগুলোর রঙ লাল ও উজ্জ্বল হলুদাভ। এখানকার চারটি শিব মন্দিরের প্রত্যেকটি একই নকশায় গড়া। প্রতি বছর রাজধানীর দুর্গা পূজার সব থেকে বড় আয়োজনটি হয় এখানে। এছাড়া জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রাও শুরু হয় এই মন্দির প্রাঙ্গণ থেকেই।
রমনা কালী মন্দির
বাংলা একাডেমির বিপরীতে ও ঢাকার রমনা পার্কের বহির্ভাগে অবস্থিত গোটা মন্দির কমপ্লেক্সের আয়তন প্রায় ২ দশমিক ২৫ একর। জনশ্রুতি অনুসারে, আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে গোপালগিরি নামের এক সন্ন্যাসী ঢাকায় সাধন-ভজনের একটি আখড়া গড়ে তোলেন। এই আখড়াতেই আরও ২০০ বছর পর আরেক বড় সাধু হরিচরণ গিরি নির্মাণ করেন মূল রমনা কালীমন্দির। সেই থেকে মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী বহু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। মন্দিরের সামনে বড় দিঘিটি একসময় দর্শনার্থী ও উপাসকদের সাঁতার কাটার জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিল। প্রধান অনুষ্ঠান কালী পূজা হলেও এখানে দুর্গাপূজাও বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়।গুলিস্তান থেকে বাসে করে মৎস্য ভবন পর্যন্ত এসে অথবা রিকশা যোগে গুলিস্তান থেকে সরাসরি যাওয়া যায় রমনা কালীবাড়িতে।
ধামরাই জগন্নাথ রথ
ঢাকার ধামরাই উপজেলায় অবস্থিত এই রথ মন্দিরটি দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। আষাঢ় মাসে এখানে অনুষ্ঠিত রথযাত্রাটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। ১৬৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জগন্নাথ মন্দিরের একদম শুরুতে রথ তৈরি হতো বাঁশ দিয়ে। ১৯৩৩ সালে পুনর্নির্মাণের পর তিনতলা বিশিষ্ট রথের উচ্চতা ছিল ৬০ ফুট এবং চওড়া ৪৫ ফুট। রথের ৩২টি অতিকায় চাকার সবগুলোই ছিল কাঠের। ২০১০ সালে সংস্কারের পর বর্তমানে রথটির আকৃতি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ২৭ ফুট, আর চাকার সংখ্যা ১৫টি। আমূল পরিবর্তনের পর তিনতলার রথটি সুশোভিত করা হয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি দিয়ে।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন
ভারতের বেলুড় মঠ নামে পরিচিত রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা হচ্ছে পুরান ঢাকার টিকাটুলিতে অবস্থিত এই মঠ ও মিশন। গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র আধঘণ্টার পায়ে হাঁটা দূরত্বের এই ধর্মীয় স্থানটি গড়ে উঠেছিল রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলনকে উৎসর্গ করে। ১৯১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রামকৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী প্রেমানন্দ।মন্দিরটিতে প্রায় ৬০০ লোকের জায়গা হয়। ৫ প্রবেশপথের ষড়ভুজাকৃতির মন্দির ঘরটিকে শুধু পিছন দিক বাদ দিয়ে বাকি সব দিক থেকে দেখা যায়। প্রধান চূড়াটিকে ঘিরে রয়েছে ৬টি সংলগ্ন ছোট ছোট চূড়া।এখানকার প্রধান অনুষ্ঠানগুলো হলো দুর্গা পূজা, শ্রী সারদা দেবীর জন্মদিন, স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন ও শ্রী রামকৃষ্ণের জন্মদিন।
স্বামীবাগ ইসকন মন্দির
মন্দিরটির প্রাচীন নাম শ্রীশ্রী রাধা গোবিন্দ মন্দির, যেটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৯ সালে। শ্রীরুদ্র ত্রিদণ্ডী ত্রিপুরলিঙ্গ স্বামীর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই মন্দিরের আরও একটি নাম স্বামীবাগ আশ্রম। ২০০০ সালে আশ্রমের তাৎকালীন সেবায়েত শ্রী যশোদা নন্দন আচার্য আশ্রমের দায়িত্ব বাংলাদেশ ইসকনের কাছে সমর্পণ করেন। সেই থেকে গেন্ডারিয়ার ৭৯ স্বামীবাগ রোডে আশ্রমটির যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছেএই ইসকন মন্দির থেকে প্রতি বছর মহা সমারোহে শুরু হয় জগন্নাথের রথযাত্রা, যার সমাপ্তি ঘটে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে গিয়ে।গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি হওয়ায় পায়ে হেঁটে আধঘণ্টায় বা রিকশায় ১৫ মিনিটেই মন্দিরে পৌঁছা যায়।
ইউআর
আপনার মতামত লিখুন :