ঢাকা : নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম লক্ষ্য স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী, কার্যকর ও স্বাবলম্বী করা। তবে আইনগত সীমাবদ্ধতা, এমপিদের উপদেষ্টা হিসেবে রাখা, চেয়ারম্যানের চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বেশি ক্ষমতা, প্রশাসনিক জটিলতা, হস্তান্তরিত দপ্তর হস্তান্তর না করা, প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা, ভাইস চেয়ারম্যানদের কাজ না থাকাসহ নানা কারণে অকার্যকর হয়ে পড়েছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তর উপজেলা পরিষদ। তবে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ কার্যকর না হওয়ায় পঙ্গুই থেকে যাচ্ছে উপজেলা পরিষদ।
দেশের প্রথম উপজেলা পরিষদ গঠন করেছিলেন তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮২ সালে দেশে উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৮৫ সালে। কিন্তু ১৯৯১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার উপজেলা পরিষদ পদ্ধতি বাতিল করে। এরপর ২০০৮ সালে আবার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ পদ্ধতি পুনরায় চালু করে ওই সময় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরপর দীর্ঘ ১৮ বছর পর ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য একটি স্বাধীন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করা হয়। তবে এই কমিশন মাত্র চার মাস কাজ করার পর নতুন নির্বাচিত সরকারের প্রথম সংসদীয় অধিবেশনে এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ আইনে পরিণত না হওয়ায় তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ সংশোধন করে পুনঃপ্রচলন করে। উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ ২০০৮ জাতীয় সংসদে আইনে পরিণত না করায় বাতিল হয়ে যায়।
জানা যায়, ১৯৮২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত উপজেলা পরিষদে আইনগতভাবে এমপিদের সরাসরি কোনো প্রভাব ছিল না। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে উপজেলা পরিষদে এমপিদের উপদেষ্টা করা হলেও পরিষদ তাদের মতামত গ্রহণে বাধ্য ছিল না। ২০০৮-এর উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশে এমপিদের পরিষদের উপদেষ্টা থেকে বাদ দেওয়া হলেও ২০০৯ সালে আবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের পরামর্শ শুনতে বাধ্য করা হয় পরিষদকে। অন্যদিকে, ১৯৮২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যানদের তত্ত্বাবধানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের রাখা হলেও ১৯৯৮-এর পরিবর্তিত আইনে তাদের পরিষদের সচিব করা হয়। গত বছর স্থানীয় সরকার বিভাগের এক আদেশে পরিষদের মুখ্য নির্বাহী হিসেবে ইউএনওদের বলা হয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যানরা বলছেন, উপজেলা পরিষদে ইউএনওরা সচিব হিসেবে কাজ করেন। এজন্য তারা মুখ্য নির্বাহী হতে পারেন না। কারণ, তারা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এবং চেয়ারম্যানরা প্রধান নির্বাহী। এতে উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের ওপর তিনজনের খবরদারি চেপেছে। এ ছাড়া ১৯৮২-এর অধ্যাদেশে পরিষদের সদস্য হিসেবে সরকার মনোনীত ব্যক্তিরা থাকলেও ১৯৯৮-এর আইনে তাদের বাদ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম খান বিরু বলেন, উপজেলা পরিষদের আইনে যা বলা আছে তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্নিষ্ট সবাইকে বলা হয়েছে। এর পরও কোনো কাজ হয়নি। কেউ আইনের বাস্তবায়ন চান না। সবশেষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আদালত সংবিধান ও আইন বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। সেটাও তারা কার্যকর করছেন না।
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক ও এমপির নির্দেশনায় ইউএনওরা পরিষদ পরিচালনা করছেন। পরিষদের কর্তৃপক্ষ কে কেউ জানে না। আর কর্তৃপক্ষ ছাড়া এত বড় একটা ইউনিট কীভাবে পরিচালিত হয়। এজন্য উপজেলার কর্মকর্তারা কেউ কাউকে মানছেন না। কোনো জবাবদিহিতা নেই। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে না রেখে উপজেলা পরিষদকে ভেঙে দিলে ভালো হয় বলেও মন্তব্য করেন সাইফুল ইসলাম।
উপজেলা পরিষদের সব কাজে চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিতে হবে বলে ইউএনওদের সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু হাইকোর্টের এই নির্দেশনাও পালন করা হচ্ছে না। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে দু'জন ভাইস চেয়ারম্যান থাকলেও তাদের কোনো দাপ্তরিক নথিপত্র যাচাই-বাছাই করতে দেওয়া হয় না। এমনকি প্রকল্পবিষয়ক কোনো কমিটিতে রাখা হয় না। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিদর্শন ও তদারকির ক্ষেত্রে দ্বৈত প্রশাসনিক ক্ষমতা বিরাজ করছে। কারণ, চেয়ারম্যান ও ইউএনওরা এ ক্ষেত্রে সমান ক্ষমতা ভোগ করেন। ফলে যখন কোনো বিষয়ে চেয়ারম্যান ও ইউএনওর দিকনির্দেশনা ভিন্ন থাকে, তখন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দ্বিধায় পড়ে যান। যদিও এসব ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা বেশিরভাগ সময় ইউএনওর নিদের্শনা অনুসারে কাজ করেন। এ ছাড়া সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনের আগে দীর্ঘ ১৮ বছর আমলাদের নিয়ন্ত্রণে পরিষদ পরিচালিত হওয়ার ফলে স্থানীয় প্রশাসন এককভাবে পরিষদ পরিচালনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এরপর দলীয় প্রতীকে দুর্বল নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ফলে দেশের অনেক স্থানে জনপ্রতিনিধিদের মূল্যায়ন করছেন না আমলারা।
স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, চেয়ারম্যানরা একটা 'প্রেশার গ্রুপ' হিসেবে কাজ করছেন, যাতে ইউএনওদের ওপর তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। ইউএনওদের নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তো হবে না। তিনি তো সরকারের প্রতিনিধি, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের মতো নন। ইউএনও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা। চেয়ারম্যানরা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, ইউএনওরা সেখানে ভেটিংও দিতে পারবেন। এজন্য সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রয়েছেন।
এ বিষয়ে আদালতে রিটকারীদের পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আইন অনুযায়ী সরকারের ১৭টি বিভাগে কোনো কমিটি গঠন করা হলে সেটার সভাপতি হওয়ার কথা উপজেলা চেয়ারম্যানের। দীর্ঘদিন ধরে এসব দপ্তরের বিভিন্ন কমিটিতে পরিপত্রের মাধ্যমে ইউএনওদের সভাপতি করা হয়েছে। সম্প্রতি এর সংখ্যা আরও বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানদের চেয়ে ইউএনওর ক্ষমতা বেশি। ফলে উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন আইন, বিধি ও নোটিফিকেশন অনুযায়ী ইউএনওদের চলতে হবে। এর ফলে আগের সব পরিপত্র বাতিল হয়ে যাবে।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের (অতঃপর মূল সংবিধান হিসেবে উল্লিখিত) ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়, 'প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।' আর ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়, 'আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।' কিন্তু সংবিধানের এসব নির্দেশনা এখনও অনেকটা অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, উপজেলা পরিষদে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম চলছে। যে পদ্ধতি পরিচালনা হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। সরকার সব সময় শক্তিশালী করার কথা বলছে। কিন্তু কীভাবে শক্তিশালী হবে সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে অনেক কিছুর সংস্কার প্রয়োজন। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আইনের কিছু বিষয় ঠিক করা হয়েছিল। ২০১১ সালে আবার অনেক কিছু বাদ দিয়ে আইনটাকে দুর্বল করা হয়েছে। তার পরও উপজেলাতে যে ক্ষমতা আছে, সেটা কর্মকর্তারা প্রয়োগ করছেন অন্যভাবে। অনেক চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান বোঝেন না বলে কাজ করতে পারেন না। এজন্য দু'পক্ষেরই দোষ আছে। সবাই শুধু টাকা আর ক্ষমতা খোঁজেন, কাজ করতে চান না। সূ্ত্র : সমকাল।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :