ঢাকা : অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গত ২০ মাসে সাড়ে তিনশ জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ ও বরখাস্ত করেছে সরকার। তাদের বিরুদ্ধে ওএমএস চাল, ভিজিডি কার্ড ও প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বিতরণের তালিকা তৈরিসহ গরিবের ত্রাণ ও সরকারের বিভিন্ন সহায়তা কর্মসূচিতে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য, আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া ও সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর করার মতো গুরুতর অপরাধও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। যদিও কয়েকজনের বরখাস্ত আদেশ নিয়ে নানা প্রশ্নও রয়েছে।
আবার অনেকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও বরখাস্ত করা হয়নি। শুধু তাই নয়, বরখাস্তকৃতদের কেউ কেউ সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ফের জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর দেশের মানুষের জন্য সরকারের বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সহায়তা ও নগদ অর্থ দেওয়ার কর্মসূচি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই সময় অনিয়মের অভিযোগ বেশি ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এসব জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ ও বরখাস্ত করা হয়।
তাদের মধ্যে ৩১৫ জনই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য। পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর ১২ জন এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান ৯ জন রয়েছেন। বরখাস্তের তালিকায় আছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ইরফান সেলিমও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, গত বছর করোনার প্রকোপ বাড়লে সরকার গরিব মানুষকে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এছাড়া বয়স্ক ভাতা, জেলে ভাতা, বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। অসহায়-গরিব মানুষের জন্য দেওয়া ওইসব সহায়তা প্রদানের তালিকা তৈরিতে অনিয়ম, ওইসব সহায়তা আত্মসাৎ, সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য, সরকারি কর্মকর্তাদের মারধরসহ বিভিন্ন অপরাধে অনেক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী অনেককে অপসারণও করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অপরাধ থাকার পরও আবার নির্বাচিত হয়েছে সত্য। এবার তাদের মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে হয়তো তার আগের অপরাধের সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, গত ২০ মাসে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাড়ে তিনশ জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়। তাদের অনেকেই আবার আদালতের রায় নিয়ে নিজ দায়িত্বে ফিরে এসেছেন। বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার পরও এ সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের সঠিক পরিসংখ্যান স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পাওয়া যায়নি। বরখাস্ত হওয়া অনেক জনপ্রতিনিধি পরে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি এবং আবার অনেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছেন।
গত ২০ মাসে সাড়ে তিনশ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হওয়ার ঘটনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, যে প্রক্রিয়ায় ভোট হচ্ছে তাতে অনেক ক্ষেত্রে হয়তো যোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হচ্ছেন না। ওই ব্যক্তিরা অনেক কিছুই করতে পারেন। এছাড়া যেসব অভিযোগে রয়েছে, তা যে প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। এ কারণে উচ্চ আদালতে রিট করে অনেকেই দায়িত্বে ফিরে আসছেন।
জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৩১৫ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদে। ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি ত্রাণ, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল, ভিডিডির কার্ড আত্মসাৎ, কর্মস্থলে অনুপস্থিত ও মামলাসহ বিভিন্ন কারণে তাদের বরখাস্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ২৮ জনকে অপসারণ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের আদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে জয়ী হয়ে দায়িত্বে ফিরে পেয়েছেন ৬৩ জনপ্রতিনিধি। জেলা প্রশাসকের সুপারিশ, মামলা থেকে খালাস ও কারণ দর্শানোর নোটিশের সন্তোষজনক জবাব দেওয়ায় ৪৫ জনের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, যাদের অনিয়ম-দুর্নীতি বা অন্যান্য অপরাধ নিয়ে জেলা প্রশাসক স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দিয়েছে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া কয়েকজনের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য অপরাধের প্রমাণ পাওয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়ছে। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে দেওয়া ওইসব অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি। ওইসব অভিযোগ আমলে নিলে ‘লোম বাছতে কম্বল উজাড় হওয়া’র উপক্রম হতো-এমন মন্তব্য করেন তিনি।
আরও জানা গেছে, গত ১৮ মাসে পৌরসভার ১২ জন জনপ্রতিনিধিকে বিভিন্ন অপরাধে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তাদের মধ্যে ৬ জন মেয়র ও ৬ জন কাউন্সিলর। সর্বশেষ বরখাস্ত হয়েছেন রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র মো. আব্বাস আলী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল স্থাপনসংক্রান্ত বিতর্কিত বক্তব্যের অডিও সামাজিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এবং ওই ঘটনায় তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আমিনুল ইসলাম রাবেলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার অপরাধ ছুটি নিয়ে বিদেশ গিয়ে বৃহত্তর সিলেট ডেভেলপমেন্ট ফোরাম আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সরকার ও স্থানীয় সরকার বিভাগের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। এ দুজন বর্তমান পরিষদের মেয়র।
বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে দেরিতে নাম ঘোষণা করায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো. শাহনেওয়াজ শাহানশাহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদন পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে।
এর আগে পৌরসভার স্বার্থ পরিপন্থি কাজে জড়িত থাকায় নাটোরের বাগাতিপাড়া পৌরসভার তৎকালীন মেয়র মো. মোশাররফ হোসেনকে ২১ জানুয়ারি বরখাস্ত করা হয়। জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানায় সাইবার ট্রাইবুন্যালে দায়ের হওয়া মামলায় চার্জশিট হওয়ায় সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র মো. রুকুনুজ্জামান গত বছরের ১৮ অক্টোবর, একই ধরনের ঘটনায় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পৌরসভার মেয়র মো. শহিদুল ইসলাম গত বছরের ১৯ আগস্ট এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করায় পাবনার বেড়া পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুল বাতেনকে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর বরখাস্ত করা হয়।
আরও জানা গেছে, গত ২০ মাসে চারজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ৫ জন ভাইস চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তাদের মধ্যে পাঁচজনকেই অপসারণ করা হয়েছে। দুজন বরখাস্ত আদেশ ও একজন অপসারণ আদেশের বিরুদ্ধে রিট করে স্থগিতাদেশ এনে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
তারা হচ্ছেন-রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদ, চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ফৌজিয়া খানম এবং কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম রেনু।
ফরিদ হাসান ওদুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের স্বার্থের হানিকর কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫ মে এবং অসদাচরণের অভিযোগে ফৌজিয়া খানমকে ১৪ ফেব্রুয়ারি বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। পরিষদের অন্যান্য সদস্যরা অনাস্থা দেওয়ায় পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম রেনুকে গত বছরের ৫ জুলাই বরখাস্ত করা হয়েছিল।
এছাড়া ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আব্দুল হাই আকন্দকে অসদাচরণ ও অনাস্থার কারণে বরখাস্ত করায় তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। ওই উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মো. আরব আলী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন।
অপরদিকে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান দুলাল চন্দ্র মহন্ত বরখাস্ত হন। তিনি উচ্চ আদালতে রিট করে দায়িত্বে বহাল হয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তিমূলক বক্তব্যের অডিও সামাজিক যোগাযোগ ছড়িয়ে পড়লে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম। যদিও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়।
অপরদিকে নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে মারধরের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর সেলিম ইরফান। তাকেও বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
ব্যবস্থা নেই : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনিয়মের তথ্য পাওয়ার পরও অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার ১২ নম্বর চরগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল্লাহ দুস্থ ও গৃহহীনদের জন্য সরকারের তৈরি করা দুর্যোগ সহনীয় ঘর তার আপন ভাতিজা সিদ্দিকুর রহমানকে বরাদ্দ দেন। সিদ্দিকুর রহমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাশ করেন। ঘর পাওয়ার সময়ে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী এবং তিনি অবিবাহিত ছিলেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ‘গৃহহীনদের জন্য নগদ টাকার দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ নির্মাণ নির্দেশিকা-২০১৯’ লঙ্ঘন করে এ ঘরটি বরাদ্দ দেওয়া হয় বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন জামালপুর জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ কবীর উদ্দীন। ওই ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন পেলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে থেমে যায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে মো. শহিদুল্লাহ আবারও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও চরগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল্ল্যাহ দাবি করেন-স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানের সুপারিশ এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তদন্তের ভিত্তিতে ওই ঘরটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তিনি অনিয়ম করেননি।
শুধু মো. শহিদুল্লাহ নয়, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের এমন অনেক জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্ত ও কার্যকর পদক্ষের অভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। সূত্র : যুগান্তর।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :