নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন সামনে রেখে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বন্দরনগরী। প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুগ্রুপের দীর্ঘদিনের বিরোধ এখন আবার তুঙ্গে।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিষোদ্গার বিষয়টিকে আরও খোলাসা করে দিয়েছে। মেয়র ছাড়া কাউন্সিলর পদেও দুপক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। অনেক ওয়ার্ডে দুপক্ষের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী মাঠে রয়েছেন।
অপরদিকে বিএনপির কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে মাঠে থাকা স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার দলটির অনেক নেতাকর্মী নিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে দল থেকে বহিষ্কারের পর তৈমুরবিরোধীদের অনেকেই রয়েছেন নিষ্ক্রিয়। এমন পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল সামনে চলে এসেছে।
বড় দুদলের অভ্যন্তরীণ এসব কোন্দলে নির্বাচন সহিংসতায় রূপ নিতে পারে-এমন আশঙ্কা করছেন স্থানীয় অনেক ভোটার। তবে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকার বিষয়টি মানতে নারাজ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা।
এদিকে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আইভীর পক্ষে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় অংশ না নেওয়ায় শনিবার নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম শনিবার বিকালে বলেন, নারায়ণগঞ্জে তৃণমূল আওয়ামী লীগে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নেই। তারা নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ।
আইভীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের বিজয় হবে। এটা নিয়ে কোনো ধরনের দুরভিসন্ধি করার কোনো সুযোগ নেই। ভোটের পরিবেশও ভালো আছে। ভোটারদের মধ্যে কোনো শঙ্কা নেই।
দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলীয় শৃঙ্খলার স্বার্থে এগুলো নিয়ে ১৬ তারিখের পরে যা যা ব্যবস্থা দরকার তা নেওয়া হবে। নির্বাচনে নানা ধরনের কথাবার্তা অভিযোগ আসে। আমরা একটু সময় নিয়েই আলোচনা করে এগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল বলেন, বিএনপিতে কোনো অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। আমাদের অনেক নেতাকর্মী তৈমুর আলম খন্দকারের পক্ষে কাজ করছেন। সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এতে সাতজন মেয়র প্রার্থী, সংরক্ষিত ৯টি ওয়ার্ডে ৩৪ জন নারী কাউন্সিলর এবং ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৪৮ জন কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এ সিটিতে ভোট নেওয়া হবে। এ সিটি করপোরেশনে ভোটার রয়েছেন পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৭ জন। ভোটকেন্দ্র রয়েছে ১৯০টি।
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে আইভী-শামীম দ্বন্দ্ব বহু দিনের। ২০১১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীমকে ওসমানকে হারিয়ে প্রথম মেয়র হন আইভী। তখন দলীয় প্রতীকে না হলেও আইন সংশোধনের কারণে এখন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন।
২০১৬ সালে নৌকার প্রার্থী হিসাবে বিজয়ী হন আইভী। এবার নিয়ে টানা দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন তিনি। আইভীকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকেই সব জায়গায় আলোচনা ছিল শামীম ওসমানকে নিয়ে। অতীতের বিভেদ ভুলে শামীম ওসমান আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন কিনা-সে প্রশ্ন ছিল সবখানে।
নাসিক নির্বাচন সমন্বয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত টিমের আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারাও অভ্যন্তরীণ ঐক্য ফেরানোর বিষয়ে শুরু থেকেই ছিলেন বেশ সক্রিয়। টিমের সদস্যরা প্রায় প্রতিদিনই নারায়ণগঞ্জ গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগে ঐক্য ফেরাতে সেখানকার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
কেন্দ্রীয় নেতাদের দিয়ে গঠন করা হয়েছে ওয়ার্ডভিত্তিক টিমও। এছাড়া নির্বাচনি প্রচারে মাঠে নেমেছে দলের সহযোগী সংগঠনও। জানা গেছে, নাসিক নির্বাচন সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় নেতারা শুরু থেকেই ভোটের মাঠে আইভীর পক্ষে শামীম ওসমানকে সক্রিয় করার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু তারা সফল হতে পারেননি। এর আগে নির্বাচন সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকায় নির্বাচনি কৌশল নির্ধারণী একটি বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য শামীম ওসমানকে ডেকেছিলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে ওই বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন না তিনি।
ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কলে যুক্ত হয়ে অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ ভুলে নৌকাকে বিজয়ী করতে দলের নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিন দল মনোনীত মেয়র প্রার্থী আইভীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
ওইদিন সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আইভী বলেছিলেন, শামীম ওসমান নৌকার লোক। উনি নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারেন না। উনি আমাদের দলের লোক, জননেত্রী শেখ হাসিনার কর্মী। উনি অবশ্যই নৌকার জন্য কাজ করবেন। তবে ভোটের মাঠে আইভীর পক্ষে শামীম ওসমানসহ প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতাকে সক্রিয় দেখা যায়নি।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে আলোচনা থাকলেও শনিবার বন্দর এলাকায় গণসংযোগকালে তা প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন আইভী নিজেই। বিএনপির প্রতীক ছেড়ে নির্বাচনে নামা তৈমুর আলম খন্দকারকে ‘ওসমান পরিবারের প্রার্থী’ হিসাবে অভিযোগ তুলেছেন তিনি।
আইভী বলেন, তৈমুর আলম খন্দকার শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান এই দুই ভাইয়ের ক্যান্ডিডেট। উনি বিএনপির প্রার্থী নন, স্বতন্ত্র প্রার্থী নন; তিনি ওসমান পরিবারের প্রার্থী।
শুক্রবার তৈমুরের প্রচারে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের ঘনিষ্ঠ চার ইউপি চেয়ারম্যানের অংশ নেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আইভী বলেন, এতে প্রমাণিত হয়, সারা নারায়ণগঞ্জে গত কয়েকদিন ধরে যে গুঞ্জন ছিল, তৈমুর আলম খন্দকার শামীম ওসমানের প্রার্থী-সেটি প্রমাণিত হয়েছে।
এদিকে আইভীর অভিযোগের পরে শামীম ওসমানকে ইঙ্গিত করে দলের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। শনিবার নারায়ণগঞ্জে আইভীর পক্ষে মতবিনিময় সভায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, এখানে কোনো ব্যক্তি বিষয় নয়।
এ নির্বাচনে আমি কী অবদান রাখব, দায়িত্ব পালন করব কিনা-তা আমার ওপরই নির্ভর করে। যদি আমি ব্যর্থ হই সেজন্য দলের কাছে জবাবদিহি করতে হবে, সে যেই হন না কেন। নৌকার জন্য যদি কাজ না করেন, তাহলে নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।
সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, যার কথা বলা হচ্ছে (শামীম ওসমান) তিনি একটা দলের আদর্শ নীতি-শৃঙ্খলা নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ইত্যাদি লালন করেই এত ‘বড় নেতা’ হয়েছেন।
উনি যদি আজ সেগুলো প্রতিপালন না করেন এবং দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, আমাদের কাছে যেসব খবর আসছে সেগুলোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি।
উনি আমাদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন নিশ্চিত হলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আমাদের কাছে বিকল্প থাকবে না। তার বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টি (সিদ্ধিরগঞ্জ) ওয়ার্ডই শামীম ওসমানের নির্বাচনি এলাকায়। বাকি ১৭টি ওয়ার্ড (শহর ও বন্দর) পড়েছে সেলিম ওসমানের নির্বাচনি (নারায়ণগঞ্জ-৫) আসনের মধ্যে।
নির্বাচনি এলাকায় এই দুই এমপির অবস্থানও শক্তিশালী। ফলে তাদের দুজনকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভোটের হিসাব মেলানো কঠিন।
সেখানে প্রকাশ্যে শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানকে গডফাদার আখ্যা দেওয়ার কারণে এখন বিরোধটি শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। এই বিরোধ নৌকার প্রার্থীর ভোটের সমীকরণে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা।
অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপি থেকে অব্যাহতি পেলেও তার সঙ্গে নাসিকের তিন অঞ্চলের বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতারা রয়েছেন। শুধু সিদ্ধিরগঞ্জের সাবেক বিএনপিদলীয় এমপি গিয়াস উদ্দিন এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালে আছেন।
তৈমুরের প্রচারণায় দলীয় নেতাকর্মীরা অংশ নিচ্ছেন। রাজনৈতিক কৌশলেও তৈমুর বারবার বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে। তিনি একাধিকবার বলছেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে জেতার মতো প্রার্থী হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তবে শেষ হাসি কে হাসবেন সেই সমীকরণ এখন অনেক বেশ জটিল হয়ে পড়েছে নাসিকের ভোট অঙ্কে।
মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত : আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আইভীর পক্ষে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় অংশ না নেওয়ায় মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
শনিবার ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় সংসদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় মহানগর সভাপতি হাবিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক হাসনাত রহমানের নেতৃত্বে থাকা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মেয়াদোত্তীর্ণের কথা বলা হলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল-দলীয় প্রার্থী আইভীর নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় না নামা। কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত আওয়ামী লীগের টিমের নেতারাও নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে তাদের পাননি।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা শনিবার বিকালে বলেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে যেভাবে কাজ করা দরকার ছিল তারা তা করেননি।
এছাড়া এ কমিটির (নারায়ণগঞ্জ মহানগর) মেয়াদও উত্তীর্ণ ছিল। সব মিলিয়ে সংগঠনকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করতে তাদের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। সূত্র : যুগান্তর।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ
আপনার মতামত লিখুন :