• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

ঝড়ের গতিতে উত্থান, উল্কার বেগে পতন যেসব নেতারা


নিউজ ডেস্ক মে ১৫, ২০২২, ১১:৫৩ এএম
ঝড়ের গতিতে উত্থান, উল্কার বেগে পতন যেসব নেতারা

ফাইল ছবি

ঢাকা : আওয়ামী লীগে এবং সরকারে ডা. মুরাদ হাসান, আরিফ খান জয় এবং জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান ঘটেছে অতি দ্রুত। তবে বেপরোয়া ক্ষমতা চর্চা করে তারা তাদের পতনেরও পথ তৈরি করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে তাদের উত্থান চোখে পড়ার মতো দ্রুত। পরিণতি সবার প্রায় এক। আওয়ামী লীগ থেকে পতন। দলের পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি, নয়তো মেয়াদ শেষে আর ফিরতে না পারা। লাভজনক পদ (মন্ত্রী বা মেয়র) থেকেও পদত্যাগ অথবা অব্যাহতি।

এমন তিন নেতা হলেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, সাবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। এই তালিকায় নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুলের নামও উল্লেখযোগ্য।

তাদের এই পরিণতিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সুশাসন বিষয়ক সংগঠন ‘সুজন’-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বর্ণনা করেছেন ‘ভার’ সইতে না পারা হিসেবে। তার মতে, এরা নিজেদের দায়িত্ব এবং প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়েছিলেন। জনকল্যাণের জন্য রাজনীতি না করে ক্ষমতা উপভোগ করেছেন। আর সেটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়াতেই ভুল করেছেন এবং পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছেন।

ডা. মুরাদ হাসান: 

তথ্য প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বিতর্কিত মন্তব্য এবং এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে অশ্লীল শব্দে গালাগালির কল রেকর্ড ফাঁসের পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ডা. মুরাদ হাসান। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।

এর কয়েকদিন আগে একটি টিভি টকশোতে উপস্থিত বিএনপির একজন সাবেক নারী এমপিকে ‘মানসিক রোগী’ বলে অভিহিত করে তার সঙ্গে বিতণ্ডায় লিপ্ত হন ডা. মুরাদ। এর পরদিন তার সঙ্গে এক অভিনেত্রীর কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হয়।

সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের ছাত্র রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল ছাত্রদল দিয়ে। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক ছিলেন মুরাদ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ছাত্রলীগে যোগ দেন। প্রথমে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ২০০০ সালে সভাপতি হন। ২০০৩ সালে পঞ্চম কংগ্রেসে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সদস্য নির্বাচিত হন।

ডা. মুরাদের বাবা মতিউর রহমান তালুকদার ছিলেন জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। উত্তরাধিকারের রাজনীতির সূত্রে ২০০৩ সালে জামালপুর জেলা শাখার সদস্য হওয়ার মাধ্যমে মূল দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি হয়।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারুণ্যকে প্রধান্য দিয়ে যাদের মনোনয়ন দেন তার মধ্যে মুরাদ ছিলেন অন্যতম। জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী, মেস্টা ও তিতপল্যা) আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মুরাদ হাসান।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকে জামালপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর সরকারে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

২০১৯ সালের ১৯ মে তৎকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রথম রদবদল আনা হয়। এতে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পেছনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তার বনিবনা না হওয়া এবং একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনা ভূমিকা রাখে।

আরিফ খান জয়:

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনে নাঈমুর রহমান দুর্জয়, জুনাইদ আহমেদ পলক, ডা. মুরাদ হাসানসহ অনেক তরুণকে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন দেন। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে আরেক তরুণ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ খান জয়কে মনোনয়ন দেয়া হয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হওয়ার পর সাবেক এ ফুটবলারকে যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন শেখ হাসিনা। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক এ অধিনায়কের এমপি ও মন্ত্রী হওয়াটা ছিল রাজনীতিতে বড় ধরনের চমক। তার উত্থান ছিল যতোটা চমকের, মেয়াদ শেষে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া ছিল ততোটাই আলোচিত খবর।

উপমন্ত্রী হওয়ার পর একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন জয়। মন্ত্রী হয়েও তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের ডাগআউটে দাঁড়ানো, খেলার মাঠে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রবেশ, পুলিশের এসআইকে মারধর, ব্যানারে নাম না থাকায় নিজ মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিবের কক্ষ ভাঙচুর করেন তিনি।

এলাকায় তার ভাইদের প্রতাপ ও বেপরোয়া আচরণ এবং অর্থনৈতিক কেলেংকারির জন্যও তিনি সমালোচিত ছিলেন। তার নিজের আচরণও ছিল লাগামছাড়া। ফলে আর দ্বিতীয়বারের মতো মনোনয়ন পাননি। বরং তার আসনে দলীয় মনোনয়নে বিজয়ী হয়ে এবার মৎস ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন আশরাফ আলী খান খসরু।

জাহাঙ্গীর আলম:

ক্ষমতার রাজনীতিতে বিস্ময়কর উত্থান জাহাঙ্গীর আলমের। বয়স চল্লিশের কোঠা পেরুনোর আগেই তিনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র হন। তার পতন ঘটে আরও দ্রুততার সঙ্গে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় জাহাঙ্গীর বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। এর জের ধরে গত ৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটি।

শেষ পর্যন্ত ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে। সর্বশেষ গত ২৫ নভেম্বর তাকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

জাহাঙ্গীর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে, ছাত্র হিসেবে। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গাজীপুর জেলা শাখার সহসভাপতি ছিলেন। তিনি গাজীপুর সদর ও টঙ্গী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন।

২০০৮ সালে জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। রাজনীতির পাশাপাশি নিজের নামে ফাউন্ডেশন করে সমান্তরাল একটি শক্তি সৃষ্টি করেন। ২০১৩ সালে তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রূপকার ছিলেন গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ। দল প্রার্থী হিসেবে তাকেই বেছে নেয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে জাহাঙ্গীরের অনুগতদের নেতিবাচক ভূমিকায় নির্বাচনে হেরে যান আজমত উল্লাহ। পরের বার ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পান মেয়র পদে বিজয়ী হন জাহাঙ্গীর।

মেয়র পদে বিজয়ী হওয়ার পর জাহাঙ্গীর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি ও আজমত উল্লাহর মতো প্রভাবশালী নেতাদের দূরে সরিয়ে দেন। এলাকায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য নিশ্চিত করতে তৎপর হয়ে ওঠেন।

গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান বলেন, ‘জাহাঙ্গীরের অপসারণে আওয়ামী লীগ লাভবান হয়েছে। তিনি অন্য দলের নেতাকর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আবার দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি করতেন। ক্ষমতা ও অর্থ দিয়ে এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা দলকে আরও বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচিয়েছে।’

শফিকুল ইসলাম শিমুল: 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে নাটোর-২ (নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা) আসন থেকে প্রথমবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান শফিকুল ইসলাম শিমুল। সে বছরই নাটোরে দলের সাধারণ সম্পাদক পদও পান। অথচ এর আগে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ করা শিমুলের বড় কোনো পদ ছিল না। নিজে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর পরিবারের লোকজনকে একে একে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন শাখার পদে বসান শিমুল।

২০২১ সালে নাটোরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটির অন্তত ১৪টি পদ ছিল তার পরিবারের সদস্যদের দখলে। দলীয় রাজনীতি ও কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন লাভজনক খাতও সাংসদ শফিকুল ও তার ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ন্ত্রণে ছিল তখন।

বিপুল প্রতাপশালী শিমুল এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে পদ হারান। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে কানাডায় বাড়ি এবং টাকা পাচার, ঢাকায় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট থাকার অভিযোগ উঠেছে। সূত্র: নিউজবাংলা।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School

সংবাদ পত্রের পাতা থেকে বিভাগের আরো খবর

Link copied!