ঢাকা : দুটি আসন ছাড়া সব আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘোষণা করায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে আসায় দলটির প্রত্যাশা ছিল তাদের জন্য কিছু আসন ছাড় দিয়ে প্রার্থী ঘোষণা করবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু হয়েছে উল্টো।
জাতীয় পার্টির বড় নেতা হিসেবে পরিচিত ও একাধিকবার সংসদে নির্বাচিত এমন অনেক প্রার্থীর আসনে এবার শক্ত প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। যেখানে বিজয় ছিনিয়ে আনা তাদের জন্য কঠিন হবে।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টির দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনসহ (বিএনএম) সরকারের নির্বাচনী মিত্র হিসেবে পরিচিত একাধিক দলও। এ পরিস্থিতিতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আসন থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রত্যাহার না করলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার কথা ভাবছে দলটি।
আসন ছাড়ের নিশ্চয়তা পেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসেছিল ফের সংসদের বিরোধী দলে বসার স্বপ্নে বিভোর জাতীয় পার্টি। পার্টির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, তাদের জন্য ছাড় দেওয়া আসনে নৌকার প্রার্থী না দেওয়ার আশ্বাস ছিল। এমনকি বলা হয়েছিল ছাড় দেওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউকে প্রার্থী করা হবে না। কিন্তু তা হয়নি।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ নভেম্বর মনোনয়ন দাখিলের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আসন থেকে প্রার্থী প্রত্যাহার করা না হলে নির্বাচন বর্জনের কথা ভাবছে তারা। তবে পার্টির এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হচ্ছে। নির্বাচনের কৌশল হিসেবে তারা ২৯৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। জাতীয় পার্টিসহ অন্য শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করে আসন ভাগাভাগি করা হবে।’
জাপা সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘোষণা করায় জাপার অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছেন। তাদের আসনে আওয়ামী লীগের বড় নেতারা যেমন মনোনয়ন পেয়েছেন, তেমনি জোটসঙ্গী হিসেবে নৌকা কিংবা দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী একাধিক ছোট দলের বড় নেতারা রয়েছেন। এতে ওই নেতাদের জয় নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবার রংপুর-৩ ও ও ঢাকা-১৭ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। রংপুর-৩ (রংপুর সদর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তিমণ্ডল। আসনটি ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় পার্টির আসন হিসেবে পরিচিত।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বাড়ির আসন হওয়ায় তিনি এই আসন থেকে নির্বাচন করতেন। এরশাদের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দেওয়ায় বিজয়ী হন তার ছেলে সাদ এরশাদ। কিন্তু এবার সাদকে মনোনয়ন না দিয়ে এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন জিএম কাদের।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া তুষার কান্তি মণ্ডল দীর্ঘদিন ধরে দলীয় মনোনয়ন চাইছেন। তিনি সর্বশেষ মেয়র নির্বাচন ও এরশাদের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলের সবুজ সংকেত না থাকায় তিনি শেষ মুহূর্তে সড়ে দাঁড়ান।
সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়ার বড় পরাজয়ের পর এবারের জাতীয় নির্বাচনে এ আসন পুনরুদ্ধার করতে মরিয়া আওয়ামী লীগ।
এরশাদের আসন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-১৭ আসন থেকেও মনোনয়ন কিনেছেন জিএম কাদের। যেখানে বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরাফাত সর্বশেষ উপনির্বাচনে বিজয়ী হন।
জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুর-১ আসনে জাপার বর্তমান এমপি মশিউর রহমান রাঙ্গাকে এবার দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে তার জায়গায় মনোনয়ন পেয়েছেন জিএম কাদেরের বড় ভাই মোজাম্মেল হোসেন লালুর ছেলে আসিফ শাহরিয়ার।
এদিকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন রাঙ্গা। ফলে এবার জাপার ভোট দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার সুবিধা নেবে আওয়ামী লীগ। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করীম রাজু। তিনি রংপুর আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় মুখ।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আবু হোসেন বাবলা ১৯৮৬ সালে প্রথম বিজয়ী হন। এরপর তিনি আরও চারবার সংসদ সদস্য ছিলেন। ঢাকা-৪ আসনের বর্তমান এই এমপি বড় নেতা হিসেবে পরিচিত। এবার তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে প্রস্তুত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সানজিদা খানম। বৃহত্তর শ্যামপুর (শ্যামপুর ও কদমতলী) থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সানজিদার ভালো ভোটব্যাংক রয়েছে এলাকায়।
তবে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জে পড়তে যাচ্ছেন জাপার আরেক কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। সংসদে বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলে ঝড় তুলতে পটু এ নেতা। তার আসন ঢাকা-৬ থেকে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে। তার বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ অবিভক্ত ঢাকার মেয়র ছিলেন। তাদের পরিবারের বড় ভোটব্যাংক রয়েছে এ আসনে। রাজনীতিতে কিছুটা ব্যাকফুটে থাকা সাঈদ খোকন এবার যেকোনো মূল্যে জয়ী হতে চান। ফলে কাজী ফিরোজের জয় নিয়ে বড় সংশয় রয়েছে।
জাপার কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম শিল্পপতি হিসেবে পরিচিত। তিনি ঢাকা-১ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরেক শিল্পপতি সালমান এফ রহমান। বর্তমান এমপি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এ আসনে জিততে চলেছেন এটা ধরে নেওয়া যায়। পটুয়াখালী-১ আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়া জাপার কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের বিপক্ষে এবার আওয়ামী লীগের আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী আফজাল হোসেন। তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক।
জাপার আরেক বড় নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবার আসন (চট্টগ্রাম-৫) হারাতে পারেন কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের কাছে। ইবরাহিম সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে আসায় এ আসনটি আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিতে পারে। ফলে তার আসন হারানোর সম্ভাবনা জোরালো হচ্ছে।
তবে জাপার প্রেসিডিয়াম মেম্বার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এবার কিছুটা সহজ প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন। এবার তার আসন গাইবান্ধা-১ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের আফরোজা বারী। জাপার আরেক নেতা পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এবারও নির্বাচন করবেন সুনামগঞ্জ-৪ আসন থেকে। যেখানে আওয়ামী লীগের নতুন মুখ পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহম্মদ সাদিক। রাজনীতিতে একদম নতুন প্রার্থী হওয়ায় পীর মিসবাহ কিছুটা এগিয়ে থাকবেন। একইভাবে সহজ প্রতিপক্ষ পেয়েছেন ময়মনসিংহ-৮ আসনের এমপি ও জাপা নেতা ফখরুল ইমামও।
প্রকাশ্য জোট না হলেও গত দুই নির্বাচনে জাপার সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছিল আওয়ামী লীগ। দশম সংসদ নির্বাচনে ৪২ এবং পরের নির্বাচনে ২৬ আসন ছেড়েছিল। এসব আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিল না। এবার আওয়ামী লীগের মতো জাপাও ২৮৯ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশে দলটি তাকিয়ে থাকবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দিকে।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমঝোতার মাধ্যমে গতবারের ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোর মতো এবারও উল্লেখযোগ্য আসনে ছাড় দেবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু গতবারের মতো এবার জাপা ছাড় পাবে না। এবার ছোট-বড় ও মাঝারিমানের অনেক দল নির্বাচনে এসেছে, যাদের আসন ছেড়ে দিয়ে জাপার জন্য খুব বেশি আসন রাখা কঠিন হবে। তাছাড়া জাপা নিজেরাই জিএম কাদের-রওশন এরশাদের দ্বন্দ্বে বিভক্ত থাকায় আওয়ামী লীগ সুবিধা নিতে চাইবে আসন সমঝোতায়।
নতুন রাজনৈতিক দল ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নির্বাচনে প্রার্থী দিচ্ছে। দল দুটির নেতৃত্বে রয়েছেন বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া নেতারা। কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম সরকারের সহায়তায় বিএনপির নেতাদের নির্বাচনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ফলে তাদেরও বেশ কিছু আসন ছাড়তে হবে। আবার ইসলামি বেশ কয়েকটি দল নির্বাচনে যুক্ত হওয়ায় জাপার হিসাব-নিকাশ আরও কঠিন হবে আসন সমঝোতায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, “রাজনীতির বর্তমান অবস্থায় সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই জাতীয় পার্টির। এবার সরকার আসন ছাড়তে চাইলে নিজ দলের বড় প্রার্থীদের প্রত্যাহার নিয়ে কিছুটা জটিলতা হতে পারে, তাছাড়া শেষ মুহূর্তে নামসর্বস্ব ও মাঝারি মানের কিছু দল যুক্ত হওয়ায় আসন ভাগাভাগি আরও কঠিন হতে পারে। আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে জাতীয় পার্টির সঙ্গে এবার ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও ‘বিএনএমের’ প্রতিযোগিতা হতে পারে।” সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই