ঢাকা : ১৫ বছর ক্ষমতার সঙ্গে থেকেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো নিজেদের সংগঠন সংহত করতে না পারায় জোটের নেতাদের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জোটবদ্ধ থেকেও আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়াতে না পারার ক্ষোভও তাদের ওপর রয়েছে শেখ হাসিনার। এজন্য তিনি জোটসঙ্গী নেতাদের সর্বশেষ বৈঠকে ভর্ৎসনাও করেছেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা এ কথা জানিয়ে আরও বলেন, শরিক দলগুলোর নির্ভরতা কমাতে চান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলীয় শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা ও জোটনেতাদের নৌকা প্রতীকে ভোট করার প্রবণতায় শেখ হাসিনা অনীহা প্রকাশ করেছেন। অন্য তিনবারের মতো এবার নৌকা প্রতীক না দিতে কঠোর অবস্থানে তিনি। শেখ হাসিনার নৌকা কম বরাদ্দের অবস্থানে শরিক দলের প্রার্থীরা নিরাশ হলেও মুখবুঝে সইতে হচ্ছে তাদের। উচ্চবাচ্য ছাড়াই এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হচ্ছে তাদের।
নেতারা আরও বলেন, দফায় দফায় বৈঠক করেও প্রধানমন্ত্রীর মনে জমাট বাঁধা বরফ গলাতে পারছেন না শরিক দলের কোনো নেতা। ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের প্রতি এতই ক্ষোভ শেখ হাসিনার যে, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে ঢাকার একটি আসনে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরও এ আসনটি দেওয়া হয়নি। তাকে এখন বরিশালে গিয়ে নির্বাচন করতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, সবসময় সব চাওয়া পূরণ করা যায় না।
এ প্রসঙ্গে শরিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, নৌকা প্রতীক কম বা বেশি দেওয়ার বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। তিনি বলেন, এটুকু আমরা নিশ্চিত হয়েছি, ১৪ দলীয় জোট নির্বাচন একসঙ্গে করবে। জোটের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবে। আসন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে দুয়েক দিন সময় লাগবে।
একই প্রসঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ১৪ দল জোটগতভাবে নির্বাচন করবে। কে কত আসন পাবে, কারা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবে তা চূড়ান্ত হয়নি। কাক্সিক্ষত আসন না পেলে কী করবেন সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন কীভাবে বলব? তবে ১৪ দল আছে, থাকবে এবং একসঙ্গে নির্বাচন করবে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, শরিক দলগুলোর নেতাদের নৌকা নিয়ে ভোট করার আশা যতই থাকুক, সংখ্যা আগের মতো থাকবে না। এবার তাদের নৌকা খুব কমই দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, জোটের প্রার্থীদের নৌকা যা দেওয়া হবে তা-ই মানতে হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর লাগাম টানছেন না প্রধানমন্ত্রী, শরিক দলের আশা পূরণ করার সুযোগ কমই দেখা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও জোটের একাধিক নেতা বলেন, ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে এখনো আসন সমন্বয় করেনি আওয়ামী লীগ। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা টেনে নিয়ে যেতে চায় আসন সমন্বয়ের ব্যাপারটি।
১৪ দল জোটগতভাবে ও নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চাইলেও জোটের প্রধান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সবার হাতে এবার নৌকা দিতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে আসন সমন্বয়ও চূড়ান্ত হচ্ছে না।
সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলায় মাঠে থেকেছে আওয়ামী লীগ। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে ১৪ দলীয় জোট আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলেও লড়াই-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের একা মাঠে থাকার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এবার ভীষণ ভাবিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, শরিক দলের নেতাদের মন্ত্রী বানানো হয়েছে, একসঙ্গে রাখা হয়েছে। তবু তাদের বিকশিত হতে না পারা দুঃখজনক।
ওই সূত্র আরও জানায়, নৌকার প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন করার বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হয়েছে। শরিক দলের নেতাদের কেন রাস্তা তাকে করে দিতে হবে? প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসুক সবাই।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন, ১৪ দলীয় জোটের খুব সীমিতসংখ্যক নেতা নৌকা পাবেন। বাকি প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে তিনি আরও বলেন, ‘স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে নৌকাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলে দিয়েছে। তাহলে ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থীদের কেন জেতার সুযোগ আমাকে করে দিতে হবে। গত তিনটি নির্বাচনে শরিক দলগুলোকে সঙ্গে রেখেছি। আর কত?’
বিদেশি চাপ ও বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেকোনো মূল্যে জমিয়ে তুলতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোটার উপস্থিতিও স্বাভাবিক পর্যায়ে ঘটুক চান তিনি। তাই এবার শরিক দলগুলো নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করুক তা চান না জোটের প্রধান ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আবার শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা তা মানছেন না।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর এক সদস্য বলেন, ১৪ দলীয় জোট শরিকরা যতই অনুনয়-বিনয় করুক তারা নৌকা পাবে খুব কম। জোটের প্রার্থী বা নেতা কারও আপত্তি গ্রহণ করবেন না প্রধানমন্ত্রী।
গত রবিবার রাতে সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলে ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের এক ঘণ্টা বৈঠক হলেও আসন-সুরাহা ও প্রতীক বরাদ্দ বিষয়ে সমাধান হয়নি।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা বলেন, ১৪ দলের নেতারা সময় অল্প দাবি করে আসন সমন্বয়ের সমাধান চাইলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সময় আছে দাবি করে মীমাংসায় পৌঁছতে পারেননি।
বৈঠকে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রতীক আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই এখনো পাননি।’
বৈঠকসূত্র জানায়, এবার ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার সুবিধা দিতে চান না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সবাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতে আসুক, এ কারণে আসন সমন্বয়ে ধীরগতি অনুসরণ করছে ক্ষমতাসীনরা।
১৭ ডিসেম্বর আসন সমন্বয় করে ১৪ দলীয় জোট নেতাদের জটিলতা সৃষ্টির সুযোগ দিতে আওয়ামী লীগ চায় না বলেই মিটিং-সিটিং করেও সমাধান হচ্ছে না ইস্যুটির। ১৪ দলীয় জোটের একাধিক নেতা বলেছেন, মনে হচ্ছে একটা জটিলতার সৃষ্টি হবে। জোটের নেতাদের আশা পূরণ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই