ঢাকা : ভোট বর্জনের পাশাপাশি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নানা উপায়ে প্রতিহতের চেষ্টা করেছিল বিএনপি। দলটি চেয়েছিল শেষ পর্যন্ত একতরফা নির্বাচন যেন না হয়।
আন্তর্জাতিক মহলও যেন নির্বাচন বন্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, এমনটিও তাদের চাওয়া ছিল। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। ফলে আগামীর দিন নির্দেশনা নিয়ে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থা থেকে দলকে বের করে আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিএনপির হাইকমান্ড। তাই আপাতত নরম কর্মসূচি দিয়ে দলের সাংগঠনিক গতিশীলতা এনে ধীরে ধীরে গরম কর্মসূচিতে যেতে চায় বিএনপি। দলীয় নেতাদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণসহ ছয় দিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি।
জানা গেছে, আগামী দিনের আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ করতে কাজ করছেন তারা। এ সময়ে কারাগারে থাকা নেতাকর্মীদের মুক্ত করাও অন্যতম করণীয় বলে মনে করা হচ্ছে। নতুন সরকারের এ সময়ে কঠোর কর্মসূচিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। বরং কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে আন্দোলন চাঙ্গা করার কৌশল খুঁজছেন নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সরকারের দমনপীড়নের কারণে এক দফার আন্দোলন কিছুটা গতি কমেছে। তবে আন্দোলন থেমে নেই। এটা আবার গতিশীল হবে। তবে কৌশল কী হবে সেটি সময়মতো প্রকাশ করা হবে।’
ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ বলেন, ‘জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। তাদের নিয়ে আবার একদলীয় সরকার পতনের আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি আসবে।’
বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, গত সোমবার অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব এলেও তা নাকচ করে দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বরং নেতাদের মুক্তি ও নতুন করে মাঠে নেতাদের নামার বিষয়ে জোর দিতে পরামর্শ তার। আর মাঠে নামতে হলে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে করা যাবে না সে বিষয়ে মত একাধিক নেতার।
ওই নেতারা বলেছেন, সরকার যে ছাড় দেবে না সেটি প্রমাণ হয়েছে ৩০ জানুয়ারি কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচিতে। সেদিন সরকার তাণ্ডব চালিয়েছে, স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানকে হেনস্তা করেছে। কর্মসূচি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এসএসসি পরীক্ষা, রোজা ও ঈদের বিষয়টিও সামনে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ নেতাকর্মীদের মুক্তি, একতরফা নির্বাচন বাতিল ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি জানানো হয়েছে।
এসব দাবি আদায়ে মঙ্গল ও বুধবার (১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি) ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরে, ১৭ ফেব্রুয়ারি সব জেলা শহরে এবং ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি সব উপজেলা, থানা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে ওইসব দেশের সীমান্তরক্ষীদের ছোড়া গুলিতে নিহত বাংলাদেশিদের স্মরণে বাদ জুমা সারা দেশের সব মসজিদে দোয়া মাহফিলের কর্মসূচি পালন করা হবে।
বিএনপির একাধিক নেতার মূল্যায়ন হচ্ছে, রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বর্তমানে রাজনীতিতে একটা জটিল ও কঠিন সময় পার করছে। পরবর্তী পরিস্থিতিতে মামলা ও গণগ্রেপ্তারের কারণে রাজনীতির মাঠে দলটি কোণঠাসা। জাতীয় নির্বাচন বর্জনসহ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে মতভেদ ও সিনিয়র নেতাদের দলত্যাগের ঘটনা ঘটে।
জেলা ও মহানগরে কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রুপিং থাকায় অনেকেই মাঠের কর্মসূচি থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছিলেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি রেখে গত বছর আন্দোলন জমিয়ে এনেছিল বিএনপি। কিন্তু ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
মহাসমাবেশে পণ্ড হওয়ার পর থেকে হরতাল, অবরোধসহ অসহযোগের ডাক দিয়ে ভোট বর্জনের আহ্বানে গণসংযোগও করেছে দলটি। এসব কর্মসূচি পালনে দলের নেতাকর্মী বা সমর্থকদের বড় জমায়েত বা টানা দীর্ঘসময় অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। ফলে দলটির ডাকা ধারাবাহিক অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি সরকারকে চাপে ফেলতে পারেনি।
নেতারা আরও বলছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলনের সফলতা ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করতে সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে হাইকমান্ডের পৃথক ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে।
বৈঠকে আন্দোলনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ভোট বর্জনের ডাকে জনগণ সাড়া দিয়েছে দাবি করে আন্দোলন সফল বলে মত দেন অনেকে। কেউ কেউ আত্মসমালোচনার পাশাপাশি কর্মসূচি বাস্তবায়নে সাংগঠনিক কিছু দুর্বলতার চিত্রও তুলে ধরেন। তবে মাঠ না ছাড়ার বিষয়ে সবাই একমত হন তারা। সেজন্য কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
নরম কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে আবার রাজধানীকেন্দ্রিক সমাবেশ বা মহাসমাবেশের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, সেদিকে এগিয়ে যেতে চায় দলটি। এর আগে কারাগারে আটক সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মুক্ত করার জন্য আইনজীবী ফোরামের নেতাদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
কারণ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ সিনিয়র বেশিরভাগ নেতা কারাবন্দি।
এ অবস্থায় আবার নেতাকর্মীদের মাঠে নামানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দলটি। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের দিন গত ১১ জানুয়ারি ৭৫ দিন বন্ধ থাকার পর হঠাৎ করেই তালা ভেঙে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যায় নেতাকর্মীরা।
একই দিনে খালেদা জিয়ার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরা নিয়েও সাধারণ জনগণের মধ্যে নানা কৌতূহল ছিল। যদিও গত সপ্তাহে আবারও খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি দল পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবে দলটি।
এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গতকাল রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুলকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) পদে মনোনীত করা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্তত পাঁচটি পদ খালি রয়েছে। এসব পদ পূরণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই