• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ছাত্র আন্দোলনে সাকিবের বাবার নেতৃত্বে মাগুরায় ২ হত্যাকাণ্ড


নিউজ ডেস্ক অক্টোবর ২৯, ২০২৪, ০৪:১৮ পিএম
ছাত্র আন্দোলনে সাকিবের বাবার নেতৃত্বে মাগুরায় ২ হত্যাকাণ্ড

ঢাকা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পতনের একদিন আগে মাগুরায় গত ৪ আগস্ট দুইজন বিক্ষোভকারী গুলিতে নিহত ও অন্তত ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হন। আর এই হত্যাকাণ্ডে মাগুরায় সরকার সমর্থক সশস্ত্র অস্ত্রধারীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন মাগুরা -১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি) ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বাবা খন্দকার মাশরুর রেজা (কুটিল)। 

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের বিতর্কিত নির্বাচনের আগ থেকেই তৎকালীন এমপি সাকিব আল হাসানের রাজনৈতিক কার্যক্রম তার অনুপস্থিতিতে তার বাবা তদারকি করে আসছিলেন।  

গত ৪ আগস্ট সকাল থেকে প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী শহরের ঢাকা রোডের কাছে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ছাত্রদের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। এই হামলার নেতৃত্ব দেন সাকিবের বাবা। আর এ তার সঙ্গে সাকিবপন্থি আওয়ামী লীগের আরও অনেক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। 

৪ আগস্ট মাগুরা শহরে তিন ঘণ্টারও কম সময়ের ব্যবধানে নিহত হন জেলা ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাব্বি (৩২) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফরহাদ হোসেন (২১)। 

এরা দুজনেই গুলিবিদ্ধ হন শহরের ঢাকা রোড সংলগ্ন পারনান্দুয়ালী পুরাতন ব্রিজের কাছে। রাব্বি গুলিবিদ্ধ হন সোয়া ১১টার দিকে। পরে মারা যান। আর ফরহাদ নিহত হন দুপুর ১টা ৪৬ মিনিট থেকে দুপুর ২টার মধ্যে। 

মাগুরায় এই দুই হত্যাকাণ্ড এবং প্রায় তিন ডজনের বেশি ছাত্র জনতা আহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাকিব বা তার বাবার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি। বিএনপির কর্মীদের অভিযোগ, জেলা বিএনপির নেতৃত্বে আছেন সাকিবের আত্মীয়-স্বজনরা। জ্যেষ্ঠ এই নেতারা সাকিব পরিবারের বিরুদ্ধে কৌশলে মামলা করতে দেননি। 

এদিকে, গত ২০ অক্টোবর দুপুরে মাগুরার বাড়িতে গিয়ে সাকিবের বাবা বা পরিবারের কোনো সদস্যকে পাওয়া যায়নি। তাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিতরা বলছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরে সাকিবের বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যও দেশ ছেড়েছেন। তবে তারা আসলে কোথায় অবস্থান করছেন তা নিশ্চত করা যায়নি। 

গুলির ঘটনায় যেভাবে মদদ দেন সাকিবের বাবা:
প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিক জানান, তিনি সাকিবের বাবা মাশরুর রেজা কুটিলকে দেখেছেন বেলা ১১টার কিছু আগে বিশাল বহর নিয়ে মাগুরা সদর থানার সামনে উপস্থিত হতে। এ সময় সাংবাদিকরা দূর থেকে অস্ত্রধারীদের ছবি তুলতে গেলে তাদেরকে ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। 

এই ব্যাপারে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘তখন ওদের হাতে ধারালো অস্ত্র, রামদা আর আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। আমরা তাদের ছবি তুলতে পেরেছি। কিন্তু কয়েকজন আমাদের দিকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসে।’

সে সময় ধারণকৃত একটি ভিডিওটিতে দেখা যায়, সাকিবের বাবা এবং সাকিবপন্থি আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র অবস্থায় থানার পাশে একটি মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পরে সেখান থেকে তারা ঢাকা রোডের দিকে যান। 

কিছুটা দ্রুত হেঁটে গেলে মাগুরা সদর থানার সামনে থেকে ঢাকা রোড সংলগ্ন গুলির ঘটনাস্থল পর্যন্ত পৌঁছাতে ৮ মিনিট সময় লাগে। আর এর কিছু সময় পরই গুলিবিদ্ধ হন ছাত্রদল নেতা রাব্বি। অন্তত তিন জন প্রত্যক্ষদর্শী বলছেন, রাব্বীকে ১১:১৫ মিনিটে গুলি করা হয়। 

এদিকে, ঢাকা রোডের কাছেই মাগুরা এক আসনের সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান শিখরের বাসা। তবে শিখরের আত্মীয়রা নিশ্চিত করেছেন, সেদিন তিনি মাগুরায় ছিলেন না। যদিও তার সমর্থকরা সশস্ত্র অবস্থায় তার বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। 

সেদিন সকালে সাকিবের বাবার সঙ্গে ছিলেন জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাকিব হাসান তুহিন। তুহিনের  অন্যতম ‘শুটার’ ছিল ছাত্রলীগ কর্মী শিশির অধিকারী। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শিশির অধিকারী ছাড়াও ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতা বিশেষত হামিদুল ইসলামও সেদিন গুলি চালায়। 

৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঢাকা রোডে উপস্থিত থাকা পৌর যুবলীগের এক কর্মী বলেন, ‘তুহিনরা এর আগে অন্য গ্রুপের সঙ্গে থাকলেও নির্বাচনের পর থেকে শহরে সাকিবপন্থি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।’

রাব্বি গিয়ে পৌঁছালেন এবং গুলিবিদ্ধ হলেন:
ছাত্রদল নেতা রাব্বির পরিবারের সদস্যরা বলছেন, গ্রেপ্তার এড়াতে ঘটনার দিনের আগের রাতে রাব্বি বাসায় ছিলেন না। পুলিশের এক সদস্যও বলেছেন, ৩ আগস্ট গভীর রাতে তারা রাব্বির বাসায় তাকে আটকের জন্য গিয়েছিলেন। তবে তাকে না পেয়ে তারা চলে আসেন। 

গুলিবিদ্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত, রাব্বির সঙ্গে সেদিন উপস্থিত ছিলেন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ছাত্রদল নেতা শফিকুল ইসলাম। 

তিনি জানান, সকাল থেকেই তারা ছাত্রদেরকে নিয়ে আন্দোলন জোরদার করেন। একপর্যায়ে ছাত্ররা বেশ কিছু পুলিশকে ঘেরাও করে ফেললে তিনি গিয়ে কথা বলে পুলিশদেরকে উদ্ধার করে বের হতে সহায়তা করেন।

শফিকুল ইসলাম বলেন, আর সেই মুহূর্তেই বিপরীত দিক থেকে ছাত্রদের উপরে হামলা করা হয়। হামলায় সামান্য আহত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আবার আন্দোলনে যোগদান করি।

তিনি আরও বলেন, ‘‘সে সময় দেখতে পাই আহত রাব্বি ভাইকে কয়জন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তখনো বুঝতে পারিনি, রাব্বি ভাই মারা যাবেন। যাবার সময় তিনি (রাব্বি) বলে গেলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই রাস্তা ছাড়বি না।”

রাব্বির ভাতিজা স্কুলছাত্র রিয়াজুল ইসলাম জানান, তিনি তার চাচার সঙ্গেই ছিলেন। ঘটনার ফুটেজ দেখাতে দেখাতে রিয়াজুল বলেন, ‘চাচাকে দেখলাম খুব দ্রুত এসে আন্দোলনের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। তিনি হেলমেট খুলে সেটা হাতে নিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে গুলি করা হয়। গুলির শব্দে আমি সরে যাই। পরে দেখি চাচাই আহত হয়েছেন।’

জানা যায়, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঘটনাস্থল থেকে মোটরসাইকেলে করে মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কিছু সময় পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে তার লাশ নিয়ে শহরের ভায়নার মোড়ে মিছিল করা হয়। এরপর ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে—বলেন জেলা ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি আব্দুর রহিম। 

রাব্বি হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তৎকালীন সরকার দলীয় অস্ত্রধারীদের গুলিতে নিহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফরহাদ হোসেন। ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করা হলে তিনি বাড়ি মাগুরায় চলে আসেন।  

তার চাচা ইউনুস আলী বলেন, ‘আমার সাথে সর্বশেষ ১:৪৬ মিনিটে কথা হয়েছে। তখন সে যোহরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরত আসবে বলে জানায়।’

সেদিন সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের গুলি করার সময় বিক্ষোভকারী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রদল কর্মী শ্যামল। 

তিনি বলেন, ‘খুব কাছ থেকেই দেখতে পাই ছাত্রলীগ নেতা শিশির অধিকারী কাপড়ে ঢেকে তার আগ্নেয়াস্ত্রটি আমাদের দিকে তাক করছে। অন্যরাও অস্ত্র তাক করে আছে। আমার পাশেই ছিল ফরহাদ। আমি ওকে তখন চিনতাম না। আমি তাকে সতর্ক করি। আমি তাকে বলি যে, “তুমি কেন এখানে এসেছ। পেছনে যাও?” এ সময় শিশির গুলি চালানোর প্রস্তুতি নিলে আমি দ্রুত সরে যাবার চেষ্টা করি। সরে যাবার সময় আমার সঙ্গে ধাক্কা খায় ফরহাদ। আর ওর মাথা নিচু করে ফেলে। গুলিটা তার মাথার পেছনের দিকে লাগে।”’

তিনি আরও বলেন,‘বিপরীত দিক থেকে গুলি চলতে থাকায় আমি আহত অবস্থায় থাকা ফারহাদকে রেখেই  আত্মরক্ষার চেষ্টা করি। পরে ওকে নিয়ে স্থানীয় মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ফরহাদের এলাকার ছোট ভাই মোহাম্মদ জায়েদ বিন রহমান জানান, তারা একসাথে ফরহাদসহ ছয়জন রায়নগর গ্রাম থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে রওনা দেন। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে পুলিশি পাহারা ও ছাত্রলীগের নজর এড়িয়ে ঘটনাস্থলে ১১টার সময় গিয়ে পৌঁছে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

বিক্ষোভকারী ছাত্রদের সেই সময়কার ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ফরহাদকে পার্শ্ববর্তী ব্যাপারী পাড়া জামে মসজিদের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সেখান থেকে মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। 

পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা করা হয়নি, জানিয়েছেন তার মা। ‘আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি’—বলেন ফরহাদের মা শিরিনা বেগম। তবে এ ঘটনায় মামলা করেছেন জামাল হোসেন নামের এক বিক্ষোভকারী। তিনি মাগুরা-১ আসনের সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান শিখর এবং মাগুরা-২ আসনের সদ্য সাবেক এমপি বীরেন শিকদারসহ ৬৯ জনের নাম উল্লেখ করেন। পুলিশ বলছে, বীরেন শিকদার সেদিন ঘটনাস্থলের কাছেই উপস্থিত ছিলেন। 

অন্যদিকে, আরেকটি মামলা করেছে ছাত্রদল নেতা রাব্বির পরিবার। মামলার বাদী ইউনুস আলি বলছেন, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করার অনুরোধ থাকলেও খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের নাম উল্লেখ করে মামলাটা করেছেন। তিনি সেখানেও সাইফুজ্জামান শিখর এবং বীরেন শিকদারসহ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করেন। তবে সাকিব বা তার পরিবারের কারও নাম নেই মামলায়।  

প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, মূলত সাবিকের বাবার নেতৃত্বে শখানেক সশস্ত্র সন্ত্রাসীর মারমুখি ভুমিকার কারণেই সরকার পতনের একদিন আগে মাগুরা শহরে দুজন নিহত ও অন্তত ৩৫ জন আহত হন। 

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আ.লীগের এক নেতা বলেন, ‘ওইদিন সকাল থেকেই ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পারনান্দুয়ালী সেতু এলাকায় মুখোমুখি অবস্থান নেয় দুইপক্ষ। সেতুর একপাশে ছিলেন আন্দোলনকারীরা। অন্যপাশে পুলিশ ও আমাদের লোকজন। প্রায় তিন ঘণ্টা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর আমরা টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হই।’ 

সূত্র-বাংলা আউটলুক

আইএ

Wordbridge School
Link copied!