ঢাকা : হার্ট আমাদের শরীরের কেন্দ্রীয় অঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি রক্ত পাম্প করার মাধ্যমে সারা শরীরে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করে, যা শরীরের প্রতিটি কোষকে বাঁচিয়ে রাখে। তবে আমরা প্রায়ই হৃদযন্ত্রের প্রতি ততটা মনোযোগ দিই না যতটা প্রয়োজন।
হার্ট সুস্থ আছে কিনা তা নিয়মিত পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অস্বাস্থ্যকর হৃদযন্ত্র দীর্ঘমেয়াদে নানা সমস্যার জন্ম দিতে পারে। সঠিক সময়ে লক্ষণগুলো চিহ্নিত করা এবং জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনা আপনার হার্টকে সুস্থ রাখতে সহায়ক হতে পারে।
এবার জেনে নিই কীভাবে আপনি আপনার হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন এবং তা সুস্থ আছে কিনা বুঝবেন।
১. হার্টের নিয়মিত পরীক্ষা করানো : সুস্থ হৃদযন্ত্র নিশ্চিত করার প্রথম ধাপ হলো ডাক্তার দ্বারা নিয়মিত পরীক্ষা করানো। কিছু সাধারণ পরীক্ষা রয়েছে যা হার্টের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়—
ইসিজি (ECG): এটি হৃদযন্ত্রের ইলেক্ট্রিক্যাল কার্যকলাপ পরীক্ষা করে, যা হার্টের বিট নিয়ন্ত্রণ করে। ইসিজি পরীক্ষা হার্ট অ্যাটাক, আরিথমিয়া (হার্টের বিটের অস্বাভাবিকতা), বা অন্যান্য হৃদরোগের লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে সহায়ক।
ইকোকার্ডিওগ্রাফি (Echocardiogram): এটি একটি আলট্রাসাউন্ড যা হার্টের গঠন এবং কার্যক্রম পরীক্ষা করে। এই পরীক্ষা হার্টের পাম্প করার ক্ষমতা এবং হার্টের দেয়ালে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা তা দেখাতে সাহায্য করে।
স্ট্রেস টেস্ট (Stress Test): এটি সাধারণত হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করার সময় হার্টের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। শরীরে ব্যায়ামের চাপের সময় হার্ট কেমন কাজ করছে তা স্ট্রেস টেস্টের মাধ্যমে বোঝা যায়।
২. হার্টবিট নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা : হার্টের স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটি সহজ এবং কার্যকর উপায় হলো হার্টবিট নিয়মিত মাপা। একটি সুস্থ মানুষের বিশ্রামের সময় হৃদস্পন্দনের হার সাধারণত ৬০-১০০ বিট প্রতি মিনিটে (BPM) হয়। যদি আপনার হার্টবিট অতিরিক্ত কম বা বেশি হয়, যেমন ৬০ BPM এর নিচে বা ১০০ BPM এর ওপরে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন হৃদযন্ত্রের সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে।
৩. শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি ও স্বাভাবিকতা পর্যবেক্ষণ করা : শ্বাস নেওয়া আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা হার্টের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সাধারণত স্বাভাবিক চলাফেরার সময় খুব সহজে শ্বাস নেওয়া এবং ছাড়তে পারা একটি সুস্থ হৃদযন্ত্রের লক্ষণ। তবে, যদি ছোটখাটো কাজেও আপনি হাঁপিয়ে যান, বা শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা অনুভব করেন, এটি হার্টের সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। এরূপ অবস্থায় অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
৪. রক্তচাপ নিয়মিত মাপা : উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হৃদযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি হার্টের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। একটি সুস্থ মানুষের রক্তচাপ সাধারণত ১২০/৮০ mmHg এর নিচে থাকে। নিয়মিত রক্তচাপ মাপার মাধ্যমে আপনি আপনার হার্টের স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন।
৫. রক্তে কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা পরীক্ষা করা : রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কোলেস্টেরল ধমনীর প্রাচীরে জমা হয়ে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত করে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, যেমন, লো-ফ্যাট এবং ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হতে পারে।
৬. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা : ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হৃদযন্ত্রের কাজের চাপও বাড়ে, কারণ অতিরিক্ত ওজন রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল বাড়িয়ে তোলে। নিয়মিত ওজন পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা বজায় রাখা হার্টের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য জরুরি।
৭. নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক সক্রিয়তা : ব্যায়াম হৃদযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি হার্টের পাম্প করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি পর্যায়ের ব্যায়াম করা উচিত, যেমন হাঁটা, সাইকেল চালানো, বা সাঁতার কাটা। ব্যায়ামের ফলে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি শক্তিশালী হয় এবং ধমনীগুলিতে রক্ত প্রবাহ সঠিকভাবে চলতে থাকে।
৮. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা : সুস্থ হার্টের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় শাকসবজি, ফলমূল, লো-ফ্যাট প্রোটিন, এবং ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার রাখা উচিত। এছাড়াও, সম্পৃক্ত চর্বি, লবণ, এবং চিনি কম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৯. ধূমপান এবং অ্যালকোহল ত্যাগ করা : ধূমপান হার্টের রক্তনালীর ক্ষতি করে এবং রক্তচাপ বাড়ায়। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনও হার্টের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপান এবং অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আপনি হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারবেন।
১০. মানসিক চাপ কমিয়ে রাখা : মানসিক চাপ আমাদের হৃদযন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, আরিথমিয়া, এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। স্ট্রেস কমানোর জন্য যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, এবং পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
১১. পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নেওয়া : পর্যাপ্ত ঘুম হার্টের সুস্থতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুম না হলে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হার্টের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নেওয়া উচিত।
হার্টের সুস্থতা আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও জীবনের মানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সচেতন খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, এবং মানসিক চাপ কমিয়ে রাখা—এই কয়েকটি সাধারণ পরিবর্তন এনে আপনি আপনার হার্টকে দীর্ঘ সময় ধরে সুস্থ রাখতে পারবেন। সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হওয়া হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। সুতরাং, আজ থেকেই আপনার হার্টের যত্ন নেওয়া শুরু করুন, কারণ একটি সুস্থ হৃদযন্ত্রই আপনাকে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য এবং জীবন উপহার দেবে। সূত্র : জীবনস্টাইল
এমটিআই