• ঢাকা
  • শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১

ফের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে বিশ্ব


আন্তর্জাতিক ডেস্ক ডিসেম্বর ২৩, ২০২০, ০২:১৭ পিএম
ফের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে বিশ্ব

ঢাকা : ফের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে বিশ্ব। করোনা ভাইরাসের নতুন ধরনের কারণে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার অধিক সংক্রামক নতুন ধরন দেখা দেওয়ায় ইতোমধ্যে ৪০টিরও বেশি দেশ ব্রিটেন ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। একের পর এক দেশ থেকে আসছে ব্রিটিশ ফ্লাইট নিষিদ্ধের ঘোষণা। এর প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশসহ যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারেও দেখা দিয়েছে নিম্নগতি। খবর বিবিসি ও আল-জাজিরার।

ডেনমার্কেও করোনার অতি সংক্রামক রূপ ছড়িয়ে পড়ায় দেশটি থেকে বিদেশিদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সুইডেন। করোনার নতুন এ স্ট্রেইন খুব দ্রুত মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এটি আরো মারাত্মক কি না তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ব্রিটেন ভ্রমণে বিধি-নিষেধ আরোপ করা দেশের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ব্রিটেনের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে অনেক দেশ।

এ অবস্থায় ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের ইমার্জেন্সিস চিফ মাইক রায়ান বলেছেন, মহামারীর মধ্যে ভাইরাসটির বিবর্তন সাধারণ ব্যাপার এবং এটি একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। এর আগে গত রোববার যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক বলেছিলেন, ভাইরাসের নতুন রূপটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকায়ও করোনা ভাইরাসের অতি সংক্রামক একটি রূপ পাওয়া গেছে। তবে এটি ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়া নতুন ধরনের ভাইরাসটির মতো নয়।

ব্রিটেনসহ আট দেশ থেকে আসা মানুষের জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে উজবেকিস্তান। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইতালি, জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস। এ দেশগুলোর মধ্যে নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় করোনার পরিবর্তিত রূপ বা স্ট্রেইনটি শনাক্ত হয়েছে। জার্মানিতে এটির পাওয়ার অনেক বেশি আশঙ্কা রয়েছে বলে গতকাল মঙ্গলবার দেশটির একটি সংস্থা জানিয়েছে। ব্রিটেন ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা ব্যক্তিদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে গুয়াতেমালা।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব রোববার তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করেছে। সোমবার থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সব বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ এবং নিজেদের জল ও স্থল সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে কুয়েত। মঙ্গলবার থেকে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে ওমান। ইসরাইল শুধু নিজেদের নাগরিক ও বিশেষ পাস পাওয়া বিদেশিদের প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে।

ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে স্পেন নিজেদের নাগরিক ও বাসিন্দা ছাড়া ব্রিটেন থেকে আসা অন্যদের ক্ষেত্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ব্রিটেনের সঙ্গে ইতোমধ্যে ফ্রান্সের সীমান্ত বন্ধ রয়েছে। তবে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে দুই দেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার ব্যাপারে ফরাসি সরকারের সঙ্গে আলোচনায় যাচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ব্রিটেনের সঙ্গে মঙ্গলবার থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিমান যোগাযোগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। এছাড়া দেশটিতে ভ্রমণেও জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ৩১ ডিসেম্বর রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত ব্রিটেন থেকে কোনো বিমান ভারতে প্রবেশ করতে পারবে না।

এদিকে করোনা ভাইরাসের নতুন প্রজাতি শনাক্তের পর এর প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারেও দেখা দিয়েছে নিম্নগতি। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শেয়ারবাজার এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এর সূচক নিচে নেমেছে অন্তত ১ শতাংশ। ডো জোনস এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানশাসিত নাসদাকেরও অনেকটা একই অবস্থা।

এদিকে লন্ডনের এফটিএসই ১০০-এর লেনদেন কমেছে অন্তত ২ শতাংশ। জার্মানি এবং ফ্রান্সের প্রধান শেয়ারবাজারগুলোর সূচক নেমেছে ৩ শতাংশের বেশি। ব্রিটেনের ওপর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ধস নেমেছে ব্রিটিশ এয়ারলাইনগুলোর শেয়ারে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মালিক আইএজির দর কমেছে এক ধাক্কায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ইজিজেটের অবস্থা আরো খারাপ। তাদের শেয়ারের সূচক নেমেছে ৯ শতাংশ নিচে।

বিমানের ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী রোলস-রয়েসের শেয়ারেও দেখা গেছে বাজে অবস্থা। তাদের সূচক কমেছে অন্তত ৮ শতাংশ। স্বস্তিতে নেই ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলোও। এয়ার ফ্রান্স-কেএলএমের শেয়ারের সূচক কমেছে ৫ শতাংশ। একই পরিমাণ ধস বিমাননির্মাতা এয়ারবাসের। শুধু শেয়ারবাজারেই নয়, প্রভাব পড়েছে ব্রিটিশ মুদ্রার মানেও। ইউরোর বিপরীতে ইতোমধ্যে ১ শতাংশ কমেছে পাউন্ড স্টার্লিংয়ের মান, ডলারের বিপরীতে তা কমেছে অন্তত ১ দশমিক ৪ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মহামারীর আঘাত সামলে ২০২১ সালে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে গতি আশা করা হচ্ছিল, নতুন ভাইরাস প্রজাতির কারণে সে সম্ভাবনা মিলিয়ে যেতে বসেছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, ব্রিটেনে শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন প্রজাতি ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক। পুরনো প্রজাতির চেয়ে এটি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। নতুন ধরনটি ব্রিটেন ছাড়াও আরো কয়েকটি দেশেও দেখা গেছে।

স্কাই নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত মানবশরীরকে আক্রান্ত করা কোভিড-১৯ এর অন্তত সাতটি বড় গ্রুপ বা স্ট্রেইন পাওয়া গেছে। মূল স্ট্রেইনটি আবিষ্কার হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে। এর নাম এল স্ট্রেইন। এরপর ২০২০ সালের শুরুর দিকে এর রূপান্তর হয়ে এস স্ট্রেইন হয়। এরপর আবারো রূপান্তরের মধ্য দিয়ে উদ্ভব হয় ভিওজি স্ট্রেইনের।

ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে সাধারণত করোনার স্ট্রেইন জি দেখা যায়। তবে এসব মহাদেশে মানুষের চলাচলের ওপর বিধি-নিষেধ শিথিল থাকার কারণে দ্রুত এ ভাইরাস ছড়িয়েছে এবং জিআর, জিএইচ ও জিভি স্ট্রেইনের উদ্ভব হয়েছে। এদিকে আবার এশিয়াতে মূল স্ট্রেইন এলের উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময়ের জন্য ছিল। কারণ চীনসহ বিভিন্ন দেশ দ্রুত তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে চলাফেরায় বিধি-নিষেধ আরোপ করায় এর রূপান্তর হয়নি।

বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি আধিপত্যকারী স্ট্রেইন হলো জি স্ট্রেইনস। বিশেষ করে ইতালি ও ইউরোপে প্রাদুর্ভাবের পেছনে এটি দায়ী। সুনির্দিষ্ট মিউটেশনটি হলো ডি৬১৪জি। এটি সবচেয়ে পরিচিত রূপান্তর। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ভাইরাস আরো বেশি সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে। তবে কিছু গবেষণা আবার এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এরই মধ্যে মূল এল স্ট্রেইন ও ভি স্ট্রেইনের মতো শুরুর দিককার স্ট্রেইনগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে।

মহামারী মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে কার্যকরী পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এল ও এস স্ট্রেইনের সংক্রমণ রোধ করতে পেরেছে। আর জি স্ট্রেইনের কারণে যে নতুন সংক্রমণ দেখা গেছে তা এসেছে বিদেশফেরতদের মাধ্যমে। মার্চের শুরু থেকেই এশিয়াতে জি, জিএইচ ও জিআর স্ট্রেইনের প্রকোপ বাড়তে দেখা গেছে। এক মাসেরও বেশি সময় আগে থেকে এ স্ট্রেইন ইউরোপে ছড়িয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে অপেক্ষাকৃত দ্রুত বেগে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পরই এর নেপথ্যে থাকা কোভিড-১৯ এর একটি নতুন রূপান্তরকে শনাক্ত করা হয়। বিবিসির স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিনিধি জেমস গ্যালাঘার বলছেন, মূলত তিনটি কারণে করোনার নতুন এ ভ্যারিয়ান্টটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। প্রথমত, এটি ভাইরাসের অন্য সংস্করণগুলোকে প্রতিস্থাপিত করছে। দ্বিতীয়ত, এটির বিভাজন বা রূপান্তর ভাইরাসের কিছু অংশে পরিবর্তন আনে, যা গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, এসব বিভাজনের মধ্যে বেশ কিছু ল্যাবে পরীক্ষার পর দেখা গেছে যে এগুলো মানুষের দেহের কোষকে সংক্রমিত করার ভাইরাসের যে সক্ষমতা তা বাড়ায়। এই ৩ বৈশিষ্ট্যই ভাইরাসটিকে সহজে ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতা দেয়।

ভাইরাসটির সংক্রমণ কমিয়ে আনতে এরই মধ্যে চতুর্থ পর্যায়ের বিধিনিষেধ আরোপ শুরু হয়েছে।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে ৪৩ শতাংশ নতুন সংক্রমণ, পূর্ব ইংল্যান্ডে ৫৯ শতাংশ এবং লন্ডনে ৬২ শতাংশ নতুন সংক্রমণের পেছনে এ রূপান্তরিত স্ট্রেইন দায়ী। ইংল্যান্ডের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা অধ্যাপক ক্রিস হুইটি বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে খুব দ্রুত এর সংক্রমণ বেড়েছে।

প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা প্যাট্রিক ভ্যালান্স বলেন, অস্বাভাবিকভাবে এর রূপান্তর দেখা গেছে। করোনার নতুন এ স্ট্রেইনটির ২৩টি ভিন্ন ভিন্ন পরিবর্তন দেখা গেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ভাইরাসের নতুন রূপান্তরিত স্ট্রেইন (ভিইউআই-২০২০১২/০১) ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি সংক্রামক হতে পারে। এটি আর নাম্বার ০.৪ বাড়িয়ে দিতে পারে। করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে  বিধি-নিষেধ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। লন্ডন ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় টায়ার ফোর রেস্ট্রিকশনস ঘোষণা করতে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন বিজ্ঞানের পরিবর্তন হয়, তখন আমাদেরকে অবশ্যই পদক্ষেপও পাল্টাতে হবে। যখন ভাইরাস তার আক্রমণের পদ্ধতি পাল্টে ফেলে, তখন আমাদেরকে অবশ্যই নিজেদের প্রতিরক্ষার পদ্ধতি পাল্টাতে হবে। আমার কাছে কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!