ঢাকা : আগামী শীতে বিশ্ব অদৃশ্য কিছুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই দেখতে না পাওয়া জিনিসই প্রতিদিনের জীবনযাপনের জন্য খুব প্রয়োজনীয়। বলা হচ্ছে জ্বালানির কথা। গৃহস্থালি থেকে শুরু করে কলকারখানা সবকিছুর জন্যই প্রয়োজনীয় জ্বালানির সরবরাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কয়লার ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে বাড়ি-ঘর গরম রাখা এবং শিল্পকারখানা পরিচালনা করতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর আগের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে; কিন্তু দেখা যাচ্ছে শীত আসার আগেই মহামারি- পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং খালি হয়ে পড়া মজুদ পুনরায় পূর্ণ করার মতো পর্যাপ্ত গ্যাস নেই তাদের কাছে। এ অবস্থায় শীর্ষস্থানীয় গ্যাস রফতানিকারক রাশিয়া নিজেদের কাছেই আরও গ্যাস রাখতে চাচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশগুলো গ্যাস আমদানি করতে রীতিমতো একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে।
তাপমাত্রা বেশিমাত্রায় নেমে গেলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইউরোপের পরিস্থিতি এরই মধ্যে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। মহাদেশটিতে চলমান জ্বালানি সংকটের কারণে এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়ার সতর্কবার্তা দিয়েছে। চলতি বছরের এ সময়ের মধ্যে ইউরোপের স্টোরেজগুলোয় গ্যাসের মজুদ এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে কমেছে। রাশিয়া ও নরওয়ে থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস আসা কমে গেছে। এর ওপর শীতকালীন আবহাওয়ার কারণে বায়ুকলগুলো থেকে উৎপাদন কমে গেছে এবং বয়স হয়ে যাওয়া পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো থেকেও আগের মতো গ্যাস উৎপাদন না হওয়ায় ইউরোপে জ্বালানির সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় গত বছর ইউরোপে গ্যাসের দাম ৫০০ শতাংশের কাছাকাছি বেড়ে যাওয়ার ঘটনা খুব একটা অবাক করার মতো নয় এবং তা আরও রেকর্ড করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি; বিদ্যুৎ ঘাটতিতে সংকটে চীনের অর্থনীতি : গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ইউরোপের বেশ কিছু সার উৎপাদনকারী কোম্পানি উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে। সামনে উৎপাদন আরও কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সার উৎপাদন কমে গেলে কৃষকদের ব্যয় বাড়বে, ফলে বৈশ্বিক পর্যায়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। জ্বালানির উচ্চ মূল্যের কারণে অনেক গ্যাস ব্যবসায়িই বাধ্য হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে।
এমনকি উত্তর গোলার্ধে স্বাভাবিক ঠান্ডা আবহাওয়াতেও বিশ্বের অনেক স্থানে গ্যাসের দাম বেড়ে যেতে পারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনও জ্বালানির সমস্যায় ধুঁকছে। জ্বালানির অভাবে দেশটির সিরামিকস, গ্লাস এবং সিমেন্ট উৎপাদনকারী শিল্পকারখানার মতো গ্যাস প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। ফলে পোশাক থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ যন্ত্রাংশের মতো অনেক কিছুরই ঘাটতি পড়ে যেতে পারে। এতে করে এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি মারাত্মক সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি কয়লা এবং গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদ্যুতের ব্যবহারের ওপর কঠোর নজরদারি চলছে। দূষণ কমাতে বেইজিংয়ের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্য পূরণের জন্যও বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে। পোশাক কারখানা থেকে শুরু করে অ্যালুমিনিয়াম এবং সয়াবিন প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাসহ দেশটির বিশাল শিল্পখাতের বিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর নজরদারি প্রথম এসেছে। এসব শিল্প কারখানাকে কার্যক্রম কমানো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কার্যক্রম একেবারে বন্ধ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চীনের প্রায় অর্ধেক অঞ্চল বেইজিংয়ের জ্বালানি চাহিদার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠান এখন বিদ্যুৎ ব্যবহার কমানোর চাপের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে জিয়াংসু, ঝেজিয়াং ও গুয়াংডং; এই তিনটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পাওয়ারহাউজ চীনের অর্থনীতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
নমুরা হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের টিং লু সতর্ক করে বলেছেন, ‘চীনের অর্থনীতি এই প্রান্তিকে সংকোচিত হতে পারে। এ দিকে ব্রাজিলের পরিবারগুলোকেও অতিরিক্ত বিলের বোঝা টানতে হচ্ছে। পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যারা জ্বালানির ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম নয়, তাদের অর্থনীতি এক কথায় স্থগিত হয়ে পড়বে।
এ অবস্থায় পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং নীতিনির্ধারকরা লঘু তাপমাত্রার জন্য প্রার্থনা করছেন। কারণ সরবরাহ বৃদ্ধি করার জন্য এরই মধ্যে বিলম্ব হয়ে গিয়েছে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কার সঙ্গে সংকুচিত সরবরাহ শৃঙ্খল এবং দশকের সর্বোচ্চ খাদ্যমূল্যের মতো পরিস্থিতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি নিরাপত্তাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আমোস হোচেসস্টেইন বলেছেন, ‘শীতকালে যদি সত্যিকার অর্থেই বেশি ঠান্ডা পড়ে, তাহলে ইউরোপের অনেক অঞ্চলেই ঘর গরম রাখার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস থাকবে না।’
বৈশ্বিক এলএনজি আমদানি : প্রয়োজনীয় মজুদ ধরে রাখতে রেকর্ড পরিমাণ দাম দিয়ে এশিয়ার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিকারকরা জ্বালানি ক্রয় করছে। এর মধ্যে কেউ যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে এলএনজি সংগ্রহ করতে না পারে, সেক্ষেত্রে তারা কয়লা ও হিটিং অয়েলের মতো নোংরা জ্বালানি সংগ্রহ করছে। ফলে বিভিন্ন দেশের পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। কয়লা পোড়ানোর তুলনায় গ্যাসে অর্ধেক কম কার্বনডাই অক্সাইড নির্গত হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন এখন পর্যন্ত মজুদ পরিপূর্ণ করতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট শির জ্বালানি সক্ষমতার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য চীনের অনেক প্রদেশেই শিল্পকারখানায় রেশনিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ যদি অফিস ও ঘর-বাড়ি উত্তপ্ত রাখতে গ্যাস সরবরাহ শুরু করে, তাহলে কারখানাগুলো ব্যাপকহারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সমস্যার এখানেই শেষ নয়। বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে চীনের কারখানাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হলে বা কমে গেলে বৈশ্বিক পর্যায়ে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের দামও বেড়ে যাবে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত; কিন্তু এরপরেও দক্ষিণ কোরিয়ায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে; গত ২৩ সেপ্টেম্বর কোরিয়া ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রায় আট বছরের মধ্যে এই প্রথমবার তারা বিদ্যুতের দাম বাড়াতে যাচ্ছে। হঠাৎ করে ঠান্ডা শুরু হলে অনেক বিদ্যুৎ কোম্পানিই স্পট মার্কেট থেকে রেকর্ড উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনতে বাধ্য হবে।
এলএনজি আমদানি নিয়ে কিছু কিছু দেশে অভ্যন্তরীণ সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। এলএনজি সরবরাহের মূল্য নিয়ে পাকিস্তানে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত আমদানিকারকদের গ্যাস ক্রয়ের বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়েছে দেশটির বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা।
বৈশ্বিক পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন : যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরের শেষের দিকে বেশ কিছু নতুন প্রকল্প চালু হতে যাচ্ছে; এর সুবাদে দেশটির রফতানিকারকরা আরও বেশি এলএনজি রফতানির পরিকল্পনা করছে; কিন্তু বিষয় হচ্ছে, বেশি গ্যাস বিদেশে রফতানি করা হলে অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহারের জন্য গ্যাস কম হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপ ও এশিয়ার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম অনেক কম। অবশ্য দেশটিতে গ্যাসের মজুদ পাঁচ বছরের মৌসুমভিত্তিক গড়ের তুলনায় কম; যদিও যুক্তরাষ্ট্রের শেল তেল উত্তোলকরা মুনাফা কমে যাওয়ার শঙ্কা থেকে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।
এ অবস্থায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এনার্জি কনজিউমার অব আমেরিকা মজুদের পরিমাণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত রফতানি কমানোর অনুরোধ করেছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে। আর এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে বিদেশে গ্যাসের ঘাটতি পড়তে পারে। সূত্র : ব্লুমবার্গ, ইকোনমিক টাইমস ও রয়টার্স
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :