ঢাকা : করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যে ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আবারও হুমকিতে পড়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এমবস্থায় যুক্তরাজ্য সরকার ১০ ডিসেম্বর শুক্রবার থেকে নতুন কোভিড বিধিনিষেধ কার্যকর করেছে।
এ বিধিনিষেধের আওতায় জনগণকে সম্ভব হলে বাড়িতে বসে অফিস করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থল ও গণপরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে তাদের মাস্ক পরতে হবে। অমিক্রন ধরন নিয়ে নানা উদ্বেগ চলার মধ্যেই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হয়েছে।
গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়, করোনার ওমিক্রন ধরনের তীব্রতা নিয়ে সামান্য হলেও আশাবাদী হওয়ার মতো কয়েকটি কারণ আছে।
বিভিন্ন পরীক্ষাগারে পাওয়া তথ্য, দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও ভাইরাস প্রতিরোধী বিভিন্ন ওষুধ নিয়ে আশাপ্রদ খবর মিলছে। তবে আশাবাদী হলেও সতর্ক থাকার বিকল্প দেখছেন না বিজ্ঞানীরা।
তাঁরা বলেন, ‘করোনার ওমিক্রন ধরন মোকাবিলায় একেবারে সূচনা পর্বে আছি আমরা।’
ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধে আশা দেখছেন বিজ্ঞানীরা : করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে গত বছর জিবুডি (সোত্রোভাইমাব) এবং লাজেভরিওর (মলনুপিরাভির) মতো বেশ কয়েকটি ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া গেছে।
যুক্তরাজ্যে এসব ওষুধ ব্যবহার করে দেখা গেছে, তা গুরুতর অসুস্থতা ঠেকাতে সক্ষম।
যারা আগে থেকেই ক্যানসারের মতো জটিল রোগে ভুগছিলেন এবং কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁদের ক্ষেত্রেও এই ওষুধ কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
দুই ওষুধই সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটির প্রকোপ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আশঙ্কাও কমিয়ে এনেছে।
লন্ডনভিত্তিক কিংস কলেজের অধ্যাপক পেনি ওয়ার্ড বলেন, ক্যানসার রোগীর মতো আরও যাঁরা করোনাজনিত জটিলতায় ভোগার ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে নজর দিতে হবে।
সে ক্ষেত্রে উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন এ ধরনের (ওমিক্রন) বিরুদ্ধে এই ওষুধগুলোর কার্যকারিতা জরুরি। ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষের শরীরে করোনাজনিত জটিলতা ঠেকাতে এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে এ ওষুধগুলোর ভূমিকা থাকতে হবে।
পেনি ওয়ার্ড আশা করেন, বুস্টার ডোজের পাশাপাশি এ ওষুধগুলো ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের বাড়তি সুরক্ষা দেবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা : দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর থেকে দেশটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়তে দেখা গেছে। তবে প্রাথমিকভাবে যে আভাস মিলেছে, তাতে বলা যায়, করোনার আগের ঢেউয়ের তুলনায় নতুন এ ঢেউয়ে মৃত্যুহার কম।
দেশটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, করোনার ডেলটা ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের তুলনায় অমিক্রনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত সুস্থ হতে দেখা গেছে। যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কিংবা যাঁরা বাড়িতে চিকিৎসা নিয়েছেন, দুই পক্ষই ওমিক্রন থেকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছে।
যুক্তরাজ্যসহ অন্য দেশেও অমিক্রন ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্য ধরনের তুলনায় মৃদু অসুস্থতায় ভুগছেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে আশাবাদী।
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ল্যান্স টার্টল বলেন, মাত্র কয়েক মাস আগে করোনার ডেলটা ধরনের বড় ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। তখন অনেক মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
আর এর মধ্য দিয়ে দেশটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবডি (ভাইরাস প্রতিরোধী সুরক্ষাব্যবস্থা) তৈরি হয়ে থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের মানুষের মধ্যে এ ধরনের যে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়েছিল, তা দুর্বল হতে শুরু করেছে। আর এ কারণে এখানে গুরুতর সংক্রমণ বেশি হতে পারে।
যুক্তরাজ্য সরকারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা দল সেইজও একই ধরনের কথা বলেছে। বৃহস্পতিবার তারা সতর্ক করে জানিয়েছে, ডেলটার তুলনায় ওমিক্রন ধরনের তীব্রতা তুলনামূলক কম হলেও এর উচ্চ সংক্রমণক্ষমতার কারণে অনেক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। আর তাতে হাসপাতালে চাপ বাড়ছে।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক মার্টিন হিবার্ড এখনো আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘এক বছর আগের তুলনায় আমরা এখন ভালো অবস্থায় আছি। কারণ, অনেক মানুষই ইতিমধ্যে কোনো না কোনো টিকা নিয়েছেন। আবার যারা পূর্ববর্তী সময়ে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন, তাঁদের অনেকের জটিলতা কম হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।’
পরীক্ষাগারের কাজে অগ্রগতি : তৃতীয় আশাব্যঞ্জক খবর হলো, ওমিক্রনের তীব্রতা কম হওয়াজনিত ধারণার পক্ষে সম্ভাব্য জীবতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উন্মোচন করেছেন বিজ্ঞানীরা। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী মাইকেল চ্যান চি ওয়াই এ গবেষণা করেছেন।
তিনি বলেন, করোনার নতুন ধরনটি ডেলটা ধরনের তুলনায় মানুষের শ্বাসনালির উপরিভাগে অনেক বেশি সক্রিয় থাকে এবং তা কাশির সঙ্গে বের হয়ে অন্যকে সংক্রমিত করে। তবে ওমিক্রন ধরনটি ডেলটার তুলনায় মানুষের ফুসফুসে কম ছড়াতে পারে। আর এ কারণে ঝুঁকি কম থাকে।
কারণ, আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুসে ভাইরাস ছড়ালে তা তাঁর জন্য জটিলতা ও বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে। অর্থাৎ অমিক্রন ধরন অনেক দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারলেও তাঁদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পৌঁছাতে পারে না। আর এ কারণে অসুস্থতার তীব্রতা কম হতে পারে।
অবশ্য চ্যান মনে করেন, সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে। কোনো ভাইরাস যদি কম প্রাণঘাতী হয়, কিন্তু তার অনেক বেশি মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা থাকে, তবে অনেক গুরুতর রোগ হতে পারে। মৃত্যুও হতে পারে। চ্যান বলেন, অমিক্রন ধরনের সামগ্রিক হুমকির মাত্রা খুব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :