• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১
৭০ বছরের রাজত্বের অবসান

যার আলোয় উজ্জ্বল হয়েছে ব্রিটিশ সিংহাসন


আন্তর্জাতিক ডেস্ক সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২, ০৯:০৩ এএম
যার আলোয় উজ্জ্বল হয়েছে ব্রিটিশ সিংহাসন

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ

ঢাকা : ৭০ বছর রাজত্ব করার পর ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী রাজশাসক রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্যালমোরাল প্রাসাদে মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।

বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) স্কটল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। গত কয়েকদিন বেশ সীমিত হয়ে গিয়েছিল তার চলাফেরা। এমনকি রাজকীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেও যোগ দিতে পারেননি তিনি। 

যুক্তরাজ্যসহ ১৫টি রাষ্ট্রের রানি এবং রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তিনি যুক্তরাজ্যের শাসনকর্তা এবং চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধানও ছিলেন।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ব্রিটেনের রাজ পরিবারের সিংহাসনে বসছেন তার বড় ছেলে প্রিন্স চার্লস।জানা গেছে প্রিন্স চার্লস ‘রাজা তৃতীয় চার্লস’ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করবেন এবং ১৪টি কমনওয়েলথ রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে দেশের শোক-পালনে নেতৃত্ব দেবেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অনুষ্ঠিত হবে এখন থেকে ১০ দিন পর লন্ডনে। আগামী ১০ দিন লন্ডন, এডিনবরা, কার্ডিফ ও বেলফাস্টে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হবে। 

রানির রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যে তিনি যেসব দেশের (যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা) রানি ছিলেন, সেসব দেশের নেতারা, বিশ্বের অন্যান্য রাজপরিবারের প্রতিনিধিরা এবং অন্যান্য দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানেরা অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রানীর মৃত্যুর সময় তার পরিবারের সদস্যরা পাশেই ছিলেন। গতকাল সকাল থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। সে সময় থেকেই তিনি অনেকটা জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী, সে সময় থেকেই শয্যাপাশে উপস্থিত হতে শুরু করেন রানীর সন্তান ও স্বজনরা।

সংবাদমাধ্যমটির খবরে বলা হয়েছে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। হাঁটাচলা ও দাঁড়িয়ে থাকতে তার সমস্যা হচ্ছিল। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার লিজ ট্রাস যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ পেতে স্কটল্যান্ডের ব্যালমোরাল ক্যাসেলে রানীর কাছে যান। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রথা ভেঙে এটা করা হয়। সাধারণত রানী লন্ডনে থাকেন, সেখানে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হবু প্রধানমন্ত্রীরা। কিন্তু সম্প্রতি রানীর হাঁটাচলায় সমস্যা হওয়ায় লিজ ট্রাসকে ব্যালমোরালে যেতে হয়।

এরপরও ব্যালমোরাল ক্যাসেলে অবস্থান করছিলেন রানী। শারীরিক জটিলতার কারণে সিনিয়র রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে নির্ধারিত একটি বৈঠকও বাতিল করেন। এরপর বাকিংহাম প্যালেসের এক বিবৃতিতে রানীর অসুস্থতার কথা জানানো হয়। বলা হয়, তিনি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে আছেন। রানীর অসুস্থতার খবরে স্কটল্যান্ডে ছুটে যান রাজপরিবারের সদস্যরা। তার চার সন্তান প্রিন্স চার্লস, প্রিন্সেস অ্যানে, প্রিন্স অ্যান্ড্রু ও প্রিন্স এডওয়ার্ড ব্যালমোরাল ক্যাসেলে রানীর পাশে উপস্থিত হন। নাতি প্রিন্স উইলিয়াম এবং প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগানও সেখানে ছুটে যান। রানীর অসুস্থতার খবরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো থেকে শুরু অনেক বিশ্বনেতা তার সুস্থতা কামনা করে বার্তা পাঠান। যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস বলেছিলেন, রানীর অসুস্থতার খবরে পুরো দেশ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। দেশটির সাবেক ও বর্তমান অনেক রাজনৈতিক নেতাও রানীর অসুস্থতার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা : রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনে, এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি উইন্ডসর হিসেবে। তার বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং মা এলিজাবেথ বাউয়েস-লিয়ন। রাজা ষষ্ঠ জর্জের দুই সন্তানের মধ্যে এলিজাবেথ ছিলেন প্রথম। তার বোন প্রিন্সেস মার্গারেটের জন্ম ১৯৩০ সালে।

স্কুলে নয়, বাড়িতেই শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয় ছোট্ট এলিজাবেথের। তার শিক্ষক ছিলেন মারিয়ন ক্রাফোর্ড।প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে শিক্ষা না পেলেও ভাষার প্রতি এলিজাবেথের ভাল দখল ছিল, তিনি সাংবিধানিক ইতিহাস পড়েছিলেন বিস্তারিতভাবে।

রাজ সিংহাসনে : দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যখন ব্রিটেনের প্রভাব ক্রমশ কমেছে, সমাজে আমূল পরিবর্তন এসেছে, রাজতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখনও অনেকের কাছে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জনপ্রিয়তা কমেনি। ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে নিজ কর্তৃত্বে তিনি অটল থেকেছেন। অথচ তার জন্মের সময়ও কেউ ভাবেন নি তাঁর ভাগ্যে রয়েছে ব্রিটেনের সিংহাসনে আরোহণ।

এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহনের পথ খোলে যখন তার চাচা রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড রাজদণ্ড ছাড়েন। ১৯৩৬ সালে অষ্টম এডওয়ার্ড পদত্যাগ করলে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ রাজা হন।

তখন এলিজাবেথের বয়স ১০ বছর হলেও সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন তিনি। ১৬ বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে প্রথম জনসম্মুখে আসেন এলিজাবেথ। ১৯৪৫ সালে প্রশিক্ষণের জন্য যোগ দেন সামরিক বাহিনীতে।

রাজা ষষ্ঠ জর্জের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করলে সিংহাসনের উত্তরসূরি হিসেবে প্রিন্সেস এলিজাবেথের কাঁধে রাজকীয় দায়িত্বের ভার বাড়তে থাকে।

১৯৫২ সালে স্বামীকে নিয়ে যখন কমনওয়েলথ সফরে এলিজাবেথ, তখন ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারা কেনিয়াতে অবস্থানকালে রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর খবর আসে।

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সেবছরের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যু হলে সিংহাসন চলে আসে এলিজাবেথের কাছে।

১৯৫৩ সালের ২ জুন ব্রিটিশ সিংহাসনে অভিষেক হয় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের। বয়স তখন তার ২৬।

১৯৫৩ সালের জুন মাসে তার আনুষ্ঠানিক অভিষেকে দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহণ ও শপথ গ্রহণ লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেন টেলিভিশনের পর্দায়।

যুদ্ধের পর ব্রিটেন তখন কঠিন অর্থনৈতিক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভাষ্যকাররা তার অভিষেককে ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘নতুন এলিজাবেথান যুগ’ হিসাবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ উপনিবেশ তখন গুটিয়ে এসেছে। নতুন রানির দায়িত্ব নিয়ে তিনি যখন ১৯৫৩ সালে কমনওয়েলথ দেশগুলোতে দীর্ঘ সফরে বেরলেন, তখন ভারতীয় উপমহাদেশ সহ অনেক দেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে।

রাজতন্ত্র থেকে রাজপরিবার : ক্রমশ রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিচ্ছিন্ন আনুগত্যে বদল আসতে শুরু করে। সমাজের মধ্যে নানা ধ্যানধারনাও দ্রুত বদলাতে থাকে।

রানিও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলান। ক্রমশ ‘রাজতন্ত্র’-এর জায়গা নেয় ‘রাজ-পরিবার’।

রানির রাজত্বকালের মূল স্তম্ভ হয়ে ওঠে সাংবিধানিক সততা রক্ষা ।

তবে সরকারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে চলে যান রানি। রানির দায়িত্ব সীমিত থাকে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন, দেশের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত থাকা, সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে।

১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে, বাকিংহাম প্রাসাদ সিদ্ধান্ত নেয় যে রাজপরিবারকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। রানি এবং তার পরিবারও যে আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের মত ঘরকন্নার নানা কাজ করেন তা দেখাতে বিবিসিকে ‘রয়াল ফ্যামিলি’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।

রানির দৈনন্দিন ঘরসংসারের নানা ছবি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। অনেকে বলেন ওই তথ্যচিত্র রাজপরিবারের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা ও ভালবাসা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে, তবে সমালোচকরা কেউ কেউ বলেন রাজপরিবারকে নিয়ে মানুষের মনে যে দীর্ঘদিন একটা রহস্য ও রোমাঞ্চ ছিল এই ছবি তা ধ্বংস করে দেয়।

বিপর্যয় : রানি এলিজাবেথ তার দায়িত্ব পালনে নানা দেশে ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর তিনি আমেরিকা সফরে যান। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্রিটিশ রানি যিনি অ্যামেরিকান কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন।

এর এক বছরের মধ্যে তার পরিবারে নানা ধরনের কেলেংকারি ও দুর্যোগের ঘটনা শুরু হয়। রানির দ্বিতীয় ছেলে ডিউক অফ ইয়র্ক ও স্ত্রী সারা আলাদা হয়ে যান। মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান ও স্বামী মার্ক ফিলিপস্-এর বিয়ে ভেঙে যায়। প্রিন্স ও প্রিন্সেস অফ ওয়েলস্, অর্থাৎ চালর্স ও ডায়ানা বিয়েতে যে গভীর অসুখী এ খবর জানাজানি হয় । তারাও আলাদা হয়ে যান।

রানির প্রিয় বাসভবন উইন্ডসর কাসেলে ওই বছরই বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। ওই ভবন মেরামতের খরচ সাধারণ মানুষ জোগাবে নাকি তা রানির তহবিল থেকে ব্যয় করা উচিত তা নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক।

রানি ১৯৯২ সালকে ব্যাখ্যা করেন ‘অ্যানাস হরিবিলিস্’ অর্থাৎ ‘দুর্যোগের বছর’ হিসাবে।

রানির দায়িত্বে যা ছিল : রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ একজন সাংবিধানিক রাজা। তিনি যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান; যদিও তার ক্ষমতা প্রতীকী ও আনুষ্ঠানিক। তাকে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যে আইন প্রণয়ন বা আইন পাস করার ক্ষমতা দেশটির পার্লামেন্টের হাতে।

যুক্তরাজ্যের নির্বাচিত সরকার রানিকে দেশ পরিচালনার বিষয়ে তথ্য দিয়ে থাকে, যা লাল রঙের একটি চামড়ার বাক্সে করে রানির কাছে পাঠানো হত। সাধারণত, গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে বৈঠকের আগে তার সারসংক্ষেপ বা সেসব নথিতে রানির সই প্রয়োজন হবে, সেগুলো তার কাছে পাঠানো হত।

এছাড়া রানি যুক্তরাজ্যের সরকার নিয়োগ দেন। দেশটির জাতীয় নির্বাচনে যে দল জয়লাভ করে, তার প্রধানকে বাকিংহাম প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তিনি রানির সঙ্গে দেখা করার পর রানি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠনের আহ্বান জানান। জাতীয় নির্বাচনের আগে চলমান সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার ঘোষণাও আনুষ্ঠনিকভাবে রানিই দেন। রানির ভাষণের মধ্য দিয়েই যুক্তরাজ্যে নতুন পার্লামেন্টের যাত্রা শুরু হয়। যেটি ‘স্টেট ওপেনিং সেরেমনি’ নামে পরিচিত।

যুক্তরাজ্যে আইন প্রণয়ন বা আইন পাস করার ক্ষমতা দেশটির পার্লামেন্টের হাতে থাকলেও সেটি আইনে পরিণত হতে আনুষ্ঠানিকভাবে রানির অনুমতি নিতে হয়।

হাজার বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে রাজা-রানি এসেছে অনেক, তবে তাদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

৭০ বছরের এ দীর্ঘ সময়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, তাই মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করছে গোটা বিশ্ব।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!