• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১
যে সুরে ভাঙত ঘুম, সেই সুরেই চিরঘুমে রানি

৭০ বছরের এক অধ্যায়ের বর্ণাঢ্য যবনিকাপাত


আন্তর্জাতিক ডেস্ক সেপ্টেম্বর ২০, ২০২২, ০২:২১ পিএম
৭০ বছরের এক অধ্যায়ের বর্ণাঢ্য যবনিকাপাত

ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে রানির কফিন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে নেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা

ঢাকা : স্কটল্যান্ড থেকে যে অন্তিম যাত্রার শুরু হয়েছিল, মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে তা শেষ হল, উইন্ডসর প্রাসাদে ষষ্ঠ জর্জ মেমোরিয়াল চ্যাপেলে স্বামী প্রিন্স ফিলিপের পাশে চিরশয়ানে গেলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এর মধ্য দিয়ে ৭০ বছরের এক অধ্যায়ের বর্ণাঢ্য যবনিকাপাত হল।

গত ৭০ বছরে বিশ্ব অনেক পাল্টেছে, ক্ষমতার পালাবদলও হয়েছে অনেক, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন। রাজপরিবারের অন্দরমহলের সঙ্কটও আঘাত হেনেছে বারবার। তবে সব ঝড়ঝাপটা এক হাতে সামলে বিশ্বজুড়ে সসম্মানে নিজেকে এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

গত ৮ সেপ্টেম্বর ৯৬ বছর বয়সে মারা যান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তখন তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে।

১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল বাকিংহাম প্রাসাদে এলিজাবেথের জন্ম। ব্রিটিশ সিংহাসনে তার অভিষেক হয় ১৯৫৩ সালের ২ জুন।

নানা আনুষ্ঠানিকতার পর কয়েকদিন আগে রানির মরদেহ আনা হয় লন্ডনে, রাখা হয় ওয়েস্টমিনস্টার হলে। সেখানে চার দিন ধরে চলে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্ব।

সোমবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় চিরবিদায়ের ঘোষণা আগেই দেওয়া হয়েছিল, সেই অনুযায়ী সারাবিশ্ব থেকে রাষ্ট্রনেতারা এতে যোগ দিয়েছিলেন রাজকীয় সেই শোকের অনুষ্ঠানে। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দিয়েছে এই অনুষ্ঠানের বিশদ বর্ণনা।

শবযাত্রা দেখতে জনতার ঢল নেমেছিল লন্ডনে

নতুন রাজা তৃতীয় চার্লস, যুবরাজ উইলিয়ামসহ রাজপরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে এই শেষকৃত্যানুষ্ঠান অনুষ্ঠানে আলোচিত হয়ে উঠেছিল ব্যাগপাইপার।  

রানির বিভিন্ন অভ্যাসের কথা ব্রিটিশদের আগে থেকেই জানা, তবে তার মৃত্যুর পর তারা জানতে পারল সুরের প্রতি রানির অনুরাগের কথা।

রানির শাসনামলের বেশিরভাগ সময়ে, তার জানালার নিচ থেকে ব্যাগপাইপার বাজাতে হত সকালে, আর ওই পাইপারের সুরে ঘুম ভাঙত রানির। ব্রিটেনজুড়ে রানির সব প্রাসাদেই এই পাইপার বাদনের ব্যবস্থা ছিল। আর এই ব্যাগপাইপার বাদকদের পদবি হচ্ছে ‘পাইপার টু দ্য সভরেইন’।

সিএনএন জানায়, এই পাইপার অনেকটা রানির ব্যক্তিগত ‘অ্যালার্ম ক্লক’র মতো ছিলেন। প্রতি ভোরে পাইপার ১৫ মিনিট করে বাজাতেন। তবে সোমবার পাইপারকে একটি ভিন্ন ভূমিকায় বাজাতে হলো। যে সুর এতদিন রানীর ঘুম ভাঙাত, এদিন সেই সুরেই রানিকে চিরঘুমে পাঠানো হল।

রানির পাইপার এদিন ছিলেন ভিন্ন ভূমিকায়

সোমবার স্থানীয় সময় ১০টা ৪৪ মিনিটে ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে রানির কফিন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে নেওয়ার মধ্য দিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।

যুক্তরাজ্যের রাজকীয় নৌবাহিনীর রাষ্ট্রীয় কামানবাহী একটি শকটে করে ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে রানির কফিন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের পথে রওনা হয়।

রানির শবমিছিলে সামিল হন বড় ছেলে রাজা তৃতীয় চার্লস, তার বোন প্রিন্সেস অ্যান, দুই ভাই প্রিন্স অ্যান্ড্রু ও প্রিন্স এডওয়ার্ড, যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলস উইলিয়াম, প্রিন্স হ্যারিসহ ব্রিটিশ রাজ পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা।

শবমিছিল যে পথ ধরে গেছে সে পথের দুইপাশে জড়ো হয়েছিলেন লাখো মানুষ। তারা ফুল ছিটিয়ে, তালি দিয়ে রানিকে সম্মান জানান। এ সময় ভিড়ের মধ্যে অনেককে চোখ মুছতেও দেখা গেছে।

ব্রিটিশদের মনের আসনে ছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ

রানির কফিন এবং সেটিকে অনুসরণ করা শবমিছিল প্রথমে যায় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের গির্জায়। রানির কফিন গির্জায় প্রবেশের সময় সেখানে উপস্থিত দুই হাজার মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে রানিকে সম্মান জানান। যাদের মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাজা-রানি, রাজপরিবারের সদস্যসহ প্রায় পাঁচশ জন বিশ্বনেতা এবং কূটনীতিক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

গির্জায় রানির আত্মার শান্তি কামনা করে কমনওয়েলথের মহাপরিচালক ব্যারোনেস স্কটল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস বাইবেলের অংশবিশেষ পাঠ করেন।

সেখানে বিশেষভাবে রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানের জন্য জুডিথ ওয়্যারের লেখা একটি গান বাজানো হয়।

ক্যান্টার্বুরির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি ধর্মাপোদেশ দেন। গির্জার অন্যান্য নেতারা প্রার্থনা করেন।

১৯৫৩ সালের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক অনুষ্ঠানের যে গানটি গাওয়া হয়েছিল তার শেষযাত্রাও সেই গানটি গাওয়া হয়। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার গির্জার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।

রানির শেষকৃত্যে যোগ দেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা

ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় প্রার্থনা শেষে রানির শবমিছিল ৪৫ মিনিট যাত্রা করে ওয়েলিংটন আর্চে পৌঁছায়। সেই পথে মিছিলটি প্রথমে পার্লামেন্ট স্কয়ার অতিক্রম করে। সেসময় যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি যৌথ দল রানির কফিনে সম্মান (গার্ড অব অনার) জানান।

ওয়েলিংটন আর্চে পৌঁছানোর পথে শবমিছিল একে একে পার্লামেন্ট স্ট্রিট হয়ে ‘বিগ বেন’, লন্ডনের রাজকীয় দুইটি পার্ক গ্রিন পার্ক (রাজা দ্বিতীয় চার্লস ১৬৬৮ সালে এই পার্কটি উদ্বোধন করেন) ও সেন্ট জেমস পার্ক (সবথেকে পুরাতন রাজকীয় পার্ক) এবং বাকিংহাম প্যালেস অতিক্রম করে।

রানির শবমিছিল পার হওয়ার সময় বিগ বেনের কাঁটা ৬০ সেকেন্ডের জন্য ছিল স্তব্ধ।

ওয়েলিংটন আর্চে রানির কফিন শকট থেকে নামিয়ে রাজকীয় শববাহী একটি গাড়িতে তোলা হয় এবং সেটি উইন্ডসর প্রাসাদের দিকে রওনা হয়। রাজা চার্লসসহ রাজপরিবারের সদস্যরা গাড়িতে রানির কফিনকে অনুসরণ করেন। এই পথেরও দুপাশে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন।

রানিকে শেষ বিদায় জানাতে তার প্রিয় দুই কুকুর মিউক ও স্যান্ডিকে উইন্ডসর প্রাসাদের সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে আনা হয়।

দাদির শেষ কৃত্যে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দুই ভাই উইলিয়াম ও হ্যারি

উইন্ডসর প্রাসাদে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতার এই অংশের নেতৃত্ব দেন উইন্ডসর ডিন।

সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে তিনি প্রথমে প্রার্থনা বাক্য পাঠ করেন। বলেন, “মনে রেখো, হে প্রভু,  তোমার দাস এলিজাবেথকে।  যিনি বিশ্বাসের চিহ্ন নিয়ে আমাদের আগে গেছেন  এবং এখন ঘুমিয়ে আছেন।”

ডিনের প্রার্থনা করা হলে রানির কফিন থেকে রাজমুকুট, রাজদণ্ড ও রাজকীয় গোলক সরিয়ে নেওয়া হয়। সেগুলো পরে টাওয়ার অব লন্ডনে পাঠানো হবে। আপাতত সেগুলো উইন্ডসর ডিনের জিম্মায় রাখা হয়েছে।

রাজা তৃতীয় চার্লস ‘দ্য কুইন্স কোম্পানি ক্যাম্প কালার’ নামে একটি ছোট পতাকা গ্রহণ করেন এবং সেটি তার মায়ের কফিনের উপর রাখেন।

তারপর লর্ড চেম্বারলিন ব্যারন পার্কার তার দাপ্তরিক লাঠি ‘ওয়ান্ড অব অফিস’ ভেঙে এলিজাবেথের কফিনের উপর রাখেন। লর্ড চেম্বারলিন রাজকীয় কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। নিজের ‘ওয়ান্ড অব অফিস’ ভেঙে ফেলার মাধ্যমে তিনি ওই রাজা বা রানির প্রতি তার সেবার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তারপর রানির কফিন রাজকীয় ভল্টে নামানো হয়।

রানির ছবি হাতে শেষকৃত্যে এসেছিলেন অনেকে


উইন্ডসরের ডিন একটি ধর্মীয় সংগীত গান এবং গার্টার কিং অব আর্মসের সামনে রানির প্রশংসা করেন এবং তার টাইটেলগুলো উচ্চারণ করেন। রানির পাইপাররা বাজান বিলাপ সংগীত। ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ আশীর্বাদ করেন এবং উপস্থিত সবাই গেয়ে ওঠেন জাতীয় সংগীত ‘গড সেইভ দ্য কিং’। এর মধ্যদিয়ে রানির আন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় রাজা তৃতীয় চার্লস চোখের পানি ঠেকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলেন।

সেন্ট জর্জ চ্যাপেল সমাধিতে রানীর কফিন নামানোর সময় শেষবারের মতো রানির সম্মানে ব্যাগপাইপার বাজান পাইপার।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে বিদায়ী সম্মান জানান রাজা চার্লস ও যুবরাজ উইলিয়াম

এরপর রাজা তৃতীয় চার্লসসহ রাজপরিবারের সদস্যরা সেন্ট জর্জ চ্যাপেল থেকে উইন্ডসর প্রাসাদে যান। তবে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজাসহ রাজপরিবারের সদস্যরা সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে ফিরে আসেন। রানিকে সমাহিত করতে তাদের ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়।

আগের সব আচার সরাসরি দেখানো হলেও সমাহিত করার অনুষ্ঠানটি প্রচার করা হয়নি। বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে বলা হয়, এটা ‘একান্তই পারিবারিক বিষয়’।

রয়টার্স জানিয়েছে, জর্জ চ্যাপেলে স্বামী প্রিন্স ফিলিপের পাশের চিরশয়ানে থাকবেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

গত বছর ৯ এপ্রিলে ফিলিপ মারা যান। তবে তার কফিন ব্রিটেনের রাজকীয় ভল্টে সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল, যাতে তাকে রানির পাশে শায়িত করা যায়। রানি এলিজাবেথের বাবা-মাও এই ষষ্ঠ জর্জ মেমোরিয়াল চ্যাপেলেই সমাহিত আছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!