• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বিভিন্ন দেশে কমছে জনসংখ্যা, কী হবে ভবিষ্যতে?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জানুয়ারি ২৬, ২০২৩, ১০:২৪ এএম
বিভিন্ন দেশে কমছে জনসংখ্যা, কী হবে ভবিষ্যতে?

ঢাকা: বর্তমানে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে জনসংখ্যা কমছে বলে জানা যাচ্ছে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার এই প্রবণতা কোন ধরনের হুমকি না হলেও, এটি বিশ্বের জন্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে।

যেসব দেশে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার খবর জানা যাচ্ছে সেগুলো হচ্ছে- চীন, গ্রিস, পর্তুগাল, জাপান, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, ইতালি এবং ইউক্রেন। ইউক্রেনে অবশ্য যুদ্ধের কারণে জনসংখ্যা কমতির দিকে রয়েছে।

জাতিসংঘের পপুলেশন প্রসপেক্ট ২০২২ নামে এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২২ থেকে শুরু করে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৬১টি দেশের জনসংখ্যা এক শতাংশ কমবে। প্রজনন হার কমে যাওয়া এবং বড় মাত্রায় অভিবাসনই জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ।

চীনে গত ৬০ বছরের  মধ্যে প্রথমবার জনসংখ্যা কমার খবর এসেছে। চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে বর্তমানে ১৪১ কোটির কিছু বেশি মানুষ বাস করে। গত বছরের তুলনায় যা প্রায় সাড়ে আট লাখ কম। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে জন্মহার কমে যাওয়া। দেশটিতে বর্তমানে প্রতি এক হাজারে জন্মহার মাত্র ৬.৭৭।

এছাড়া জাপানে ২০১০ সাল থেকেই জনসংখ্যা কমছে। সবশেষ গত বছর দেশটিতে প্রায় ৮ লাখ মানুষ কমেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী এরইমধ্যে জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে শিশু জন্ম দিলে নগদ অর্থসহ সুবিধা বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তারপরও জাপানি জনগনকে সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করা যাচ্ছে না।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান পপুলেশন ম্যাটারস এর ক্যাম্পেইন এন্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান অ্যালিস্টেয়ার কুরি বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে গুটিকতক দেশে জনসংখ্যা কমতে শুরু করেছে। সব দেশে নয়।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনেও বলা হচ্ছে যে, বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমলেও মোট জনসংখ্যা বেড়েছে। গত এক বছরেই সারা বিশ্বের জনসংখ্যা এক বিলিয়ন বেড়ে মোট আট বিলিয়নে ঠেকেছে, যা আসলে উদ্বেগজনক।

জাতিসংঘ বলছে, বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই প্রজনন সক্ষমতা কমে গেছে। বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ এখন এমন দেশে বাস করে যেখানে প্রজনন সক্ষমতার হার ২.১ শতাংশের নিচে। কোন দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূণ্যতে রাখতে হলে প্রজনন সক্ষমতার হার ২.১ থাকতে হয়। এছাড়া অভিবাসনও জনসংখ্যা কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ।

যে দেশে অভিবাসীদের সংখ্যা কম সেখানে জন্মহার কম হয়। কারণ এই অভিবাসীরা সাধারণত তরুণ হয় এবং তারা সন্তান জন্মদানে সক্ষম। চীন আর জাপানে অভিবাসনের সুযোগ কম থাকায় অন্য দেশের তুলনায় সেখানে মানুষ কম। একারণে তাদের জনসংখ্যাও কমছে।

একই চিত্র হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডে। এই দুটো দেশেও নাগরিকদের সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে অভিবাসনের সুযোগ অবারিত থাকায় সেখানে জন্ম হার বিয়োগাত্মক হয় না।

এছাড়া যেখানে দারিদ্র্য কম, স্বাস্থ্যের সুযোগ ভাল, শিক্ষার হার বেশি, জন্মনিয়ন্ত্রণ সরঞ্জাম সহজলভ্য, লিঙ্গ বৈষম্য নেই, সেখানে মানুষ সন্তান জন্মদানে আগ্রহী কম হয়। একই ভাবে যেখানে জন্মহার বেশি থাকে সেখানে এসব সুবিধাও কম থাকে। উন্নত যেসব দেশে জন্মহার কম সেখানে নারীদের কর্মসংস্থান বেশি এবং তারা সন্তান জন্মদানকেই একমাত্র কাজ হিসেবে মনে করে না।

এছাড়া আধুনিক জীবনযাপনও কম জন্মহারকে উৎসাহিত করে। বিশেষ করে যেখানে অধিক কর্মঘণ্টা এবং শিশু যত্নকেন্দ্রের অপর্যাপ্ততা রয়েছে সেখানে জন্মহার কম। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ চীন এবং জাপান, যেখানে সন্তান লালন-পালন বেশ কষ্টসাধ্য।

চ্যালেঞ্জগুলো কী?
এই জনসংখ্যা কমে যাওয়া বিশ্বের জন্য কী ধরনের বার্তা দিচ্ছে? আর এর প্রভাবই বা কী হতে পারে? জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যা কমে গেলে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি দেখা দেয় সেটি হচ্ছে, সেই দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া।

পপুলেশন ম্যাটারস-এর ক্যাম্পেইন এন্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান অ্যালিস্টেয়ার কুরি বলেন, বয়স্ক জনসংখ্যা বেড়ে গেলে তাদের পেনশন  এবং স্বাস্থ্য সেবার প্রয়োজনীয়তা এক দিক থেকে বেড়ে যায়। অন্যদিকে তারা অর্থনীতিতে কোন ভূমিকা রাখে না। কারণ তারা কোন ধরনের উৎপাদনমূলক কাজে যুক্ত থাকেন না।

একই কারণে ওই নির্দিষ্ট অর্থনীতে এক ধরনের স্থবিরতা আসতে পারে। সংকট দেখা দিতে পারে উৎপাদন ব্যবস্থাতেও। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, বয়স্ক মানুষ বেড়ে যাওয়ার কারণে অর্থনীতির প্রতি এই চাপ সামাল দেয়া সম্ভব।

তার মতে, উৎপাদন ব্যবস্থায় অটোমেশন যুক্ত করা হলে, বা বয়স্ক মানুষকে যদি উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করা যায় তাহলে এই অবস্থা সামাল দেয়া সম্ভব। তিনি বলেন, কোনো দেশে তরুণদের সংখ্যা কমে গেলে সেখানে অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানো যেতে পারে। ফলে মানুষ বেশি সময় ধরে কাজ করার সুযোগ পাবে। তবে যদি তরুণদের সংখ্যাও বেশি থাকে তাহলে অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়িয়ে কোন লাভ হবে না। বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে তরুণদের একটা বড় অংশ বেকার সেখানে এই পদক্ষেপ কাজ করবে না।

ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রতি বছর ২০ লাখ করে মানুষ যোগ হয়। সেই অনুপাতে যদি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হয় এবং সেই সাথে যদি বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও বাড়ে তাহলে সেটি অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

তিনি মনে করেন, বয়স্ক মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা, গুণগত অবসর যদি নিশ্চিত করা যায়, তারা যদি সক্রিয় থাকেন এবং শ্রম বাজারে প্রযুক্তির ব্যবহার দিয়েও এটা সামাল দেয়া সম্ভব।

অভিবাসনের সুযোগ বাড়বে?
উন্নত যেসব দেশে জনসংখ্যা কমে, সেখানে শ্রমবাজারে চাহিদা বাড়তে থাকে। ফলে যেসব দেশে কর্মক্ষম জনশক্তি রয়েছে অনেক সময় সেসব দেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করা হয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিশ্বের জনসংখ্যার আকারে পরিবর্তন আনায় বড় ভূমিকা পালন করবে। আগামী কয়েক দশকে অভিবাসনের কারণে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪০টি দেশের প্রত্যেকটিতে কমপক্ষে দুই লাখ করে মানুষ অভিবাসন করেছে। অন্তত ১৭টি দেশে এই সময়ের মধ্যে অভিবাসী পৌঁছানোর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি যেসব দেশে অভিবাসন হয়েছে সেগুলো হচ্ছে জর্ডান, লেবানন এবং তুরস্ক। সিরিয়ার যুদ্ধের কারণে এরকম হয়েছে। 

অন্যদিকে, ১০টি দেশের প্রত্যেকটি থেকে ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ অভিবাসন করেছে। এর বড় কারণ হচ্ছে, শ্রম অভিবাসন। যেমন পাকিস্তান থেকে এক কোটি ৬৫ লাখ, ভারত থেকে ৩৫ লাখ, বাংলাদেশ থেকে ২৯ লাখ, নেপাল থেকে ১৬ লাখ, শ্রীলঙ্কা থেকে ১০ লাখ শ্রমিক অভিবাসন করেছে। এছাড়া সিরিয়া থেকে ৪৬ লাখ, ভেনেজুয়েলা থেকে ৪৮ লাখ এবং মিয়ানমার থেকে ১০ লাখ মানুষ নিরাপত্তা ও যুদ্ধ সম্পর্কিত কারণে এই সময়ে অভিবাসন করেছে।

আগামী ৩০ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা যত বাড়বে, তার অর্ধেকই ঘটবে মাত্র আটটি দেশে। এগুলো হচ্ছে কঙ্গো, মিশর, ইথিওপিয়া, ভারত, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপিন এবং তাঞ্জানিয়া। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত কিছু দেশে জনসংখ্যা এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দেশে শ্রমিকদের অভিবাসনের সুযোগ তৈরি হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, উন্নত অর্থনীতিতে যদি স্বাস্থ্যবান বয়স্ক মানুষের সংখ্যা না বাড়ে, নির্ভরতা বেশি বাড়ে এবং তরুণদের সংকট থাকে তাহলে তাদেরকে বাধ্য হয়ে অন্য দেশ থেকে শ্রমিক নিতে হবে। এর ফলে যেসব দেশে জনসংখ্যা বেশি, শ্রমিকের সংখ্যা বেশি সেখান থেকে অভিবাসনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

তবে এই গবেষক মনে করেন, বাংলাদেশ ২০৪৭ সাল নাগাদ বয়স্ক মানুষের সমাজ বা ওল্ডার সোসাইটিতে পড়ে যাবে। তিনি বলছেন ২০৬০ সালে বিশ্বের সপ্তম বয়স্ক সমাজে পরিণত হবে বাংলাদেশ।

২০৩০ সালের মধ্যে জনসংখ্যার সাত শতাংশর বেশি মানুষের বয়স হবে ৬৫ বছরের বেশি। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা দরকার বলে তিনি মনে করেন। সূত্র: বিবিসি

সোনালীনিউজ/এম

Wordbridge School
Link copied!