ঢাকা : হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তার দেশ এখন ‘যুদ্ধের মধ্যে আছে।’ প্রতিরক্ষামন্ত্রী দেশটির সেনাবাহিনীকে গাজা ভূখণ্ড ‘পুরোপুরি অবরুদ্ধ’ করার নির্দেশ দিয়েছেন। গত দুই দিন ধরে গাজায় তীব্র বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক ভবন। নিজেদের উপর সহসা নেমে আসা এই দুর্যোগে প্রাণ বাঁচাতে কোথাও এমনকি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকুও নেই গাজার সাধারণ ফিলিস্তিনিদের।
২০০৫ সালে গাজা ছাড়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ২০০৭ সালে গাজার ক্ষমতায় আসে। তার পর থেকে প্রায় ১৭ বছর ধরে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে ছোট্ট এই ভূখণ্ডটি।
মিশর এবং ইসরায়েল গাজাকে রীতিমত অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এমনকি গাজার আকাশ ও নৌসীমার নিয়ন্ত্রণও দেশদুটির হাতে। যে কারণে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গাজাকে ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ খোলা কারাগার’ বলে বর্ণনা করেছে।
গাজা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এলাকার অন্যতম। ১৪০ বর্গমাইলের ছোট্ট এই ছিটমহলে ২০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের নিত্য সংঘাত চলে। কিন্তু শনিবার ভোর থেকে যা ঘটছে সেটি নজিরবিহীন। ওইদিন ভোরে গাজা সীমান্তবর্তী দক্ষিণ ইসরায়েলের বাসিন্দারা ঘুমের ঘোরেই হামাসের মুহুর্মুহুর রকেট হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়ে।
মাত্র ২০ মিনিটের মত সময়ে গাজা থেকে ইসরায়েলের দিকে পাঁচ হাজার রকেট ছোড়ার দাবি করেছে হামাস। তারপর হামাস যোদ্ধারা বন্দুক হাতে সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলের কয়েকটি এলাকায় প্রবেশ করে রীতিমত তাণ্ডব চালায়। তাদের নির্বিচার গুলি আর রকেট হামলায় দেশটিতে সাতশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে রোববার সিএনএন-কে নিশ্চিত করে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)।
আকস্মিক ওই হামলার ধাক্কা কাটিয়ে গাজার উপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। গত ৪৮ ঘণ্টায় গাজাকে তারা ঝাঁজরা করে ফেলেছে। তাদের হামলায় গাজায় অন্তত ৫৬০ ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় তিন হাজার জন আহত হয়েছেন বলে সোমবার জানায় ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে সড়কগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, যত্রতত্র ধ্বংসস্তূপের পাহাড়, বাতাসে ধূলা আর বারুদের গন্ধ।
ইসরায়েলের আকাশ হামলায় ৫৫ বছরের সালিম হুসেইনদের বহুতল ভবনটি ধ্বংস হয়ে গেছে। মাত্র পাঁচ মাস আগে পরিবার নিয়ে তিনি ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় বাস করতে শুরু করেছিলেন। কেন তাদের ভবনটিতে হামলা চালানো হল তা তিনি জানেন না জানিয়ে সিএনএন-কে বলেন, হামলা চালানোর অল্প কিছুক্ষণ আগে ইসরায়েলের বাহিনী তাদের সতর্ক করে ভবন খালি করতে দিতে বলে।
আমরা এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়ি। আমাদের আর কিছু নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই।
হামাসের হামলার পর গাজা উপত্যকার বাসিন্দাদের এখন এরেজ ক্রসিং অতিক্রম করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কারণ, সেখানে হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছে।
ইসরায়েলের বিমান হামলা শুরু হওয়ার পর গাজায় এক লাখ ২৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে রোববার রাতে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছে জাতিসংঘ। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা কিন্তু গাজা ছাড়ার সুযোগ পাননি। তারা শুধু মাত্র নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
রোববার স্থানীয় সময় রাত ৯টা পর্যন্ত প্রায় ৭৪ হাজার গাজাবাসী ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটির জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বলে ওই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে
পরদিন সোমবার ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েল গাজার আল-শাতি ও জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে হামলা চালিয়ে ‘বহু মানুষকে হত্যা করেছে’।
গাজার হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষ উপচে পড়ছে। তার উপর নেই বিদ্যুৎ। ইসরায়েল বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার পর সেখানে দিনে চার ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। জ্বালানি, ওষুধ এবং খাবার সরবরাহও বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছে ইসরায়েল।
আইডিএফ জানিয়েছে, তারা গাজার আশপাশে ইসরায়েলের যে এলাকাগুলোতে হামাস যোদ্ধারা অবস্থান নিয়ে লড়াই করছিল সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। এখন তারা গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের দিকে অধিক মনযোগ দিয়েছে।
আইডিএফ বলছে, তাদের লক্ষ্য হামাস যোদ্ধাদের ধ্বংস করা। তাই তারা সীমান্ত সংলগ্ন আবাসিক এলাকাগুলো থেকে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বলেছে।
কিন্তু অবরুদ্ধ গাজার বাসিন্দাদের আসলে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়া এই ভূখণ্ড চারিদিক দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। অনেকটা ইঁদুরের কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মত অবস্থা হয়েছে গাজার বাসিন্দাদের।
রাফাহ সীমান্ত পারাপার এলাকা দিয়ে গাজার এই ফিলিস্তিনিরা যে মিশরে আশ্রয় নেবে সে উপায়ও নেই। কারণ, মিশর সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
৭৫ বছরের হানি এল-বাওয়াব জানান, তার পরিবারের চার সদস্য রাতভর জেগে থাকেন। তাদের বাড়ির পাশের একটি বহুতল ভবনে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়েছে এবং ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপে তার বাড়িটিও চাপা পড়েছে। ফলে পরিবার নিয়ে তিনি এখন রাস্তায় নেমে এসেছেন।
হানি বলেন, আমি জানি না কী করব। গাজার মানুষরা চরম ভয় ও আতঙ্কে দিন পার করছে। যে কোনও সময় বোমা হামলার শিকার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি এখন শুধু সন্তানদের নিয়ে থাকার মত একটা আশ্রয় চাই। শুধু একটু আশ্রয়।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :