ঢাকা : পাকিস্তানে ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ও তিনটি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের পর গতকাল রবিবার পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশ করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের রেকর্ডসংখ্যক জয়ের পর সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা জোগাড় করতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে দল হিসেবে সর্বোচ্চ আসন পাওয়া পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)।
শোনা যাচ্ছে, দল হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাওয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য বিলাওয়ালের নাম প্রস্তাব করেছে, যা নিয়ে চলছে দরকষাকষি।
আবার নির্বাচন নিয়ে অসন্তোষের জেরে বিক্ষোভ করছেন ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) অনুসারী ও নেতাকর্মীরা। তবে সব ছাপিয়ে সবার নজর জোট রাজনীতির জটিল রসায়নের ওপর।
রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের অনুসারীরা যখন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে দেশব্যাপী বিক্ষোভ করছিলেন, তখন পিপিপির সঙ্গে দেনদরবারে ব্যস্ত ছিলেন নওয়াজ অনুসারীরা। এদিন ফল ঘোষণার পর প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন পিএমএল-এন ও পিপিপির নেতারা। ওই বৈঠকে ‘দেশকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রক্ষায়’ দুপক্ষের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে বলে পিএমএল-এনের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
পিএমএল-এন প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফ গতকাল দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে লাহোরে পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির বাসভবনে যান। সেখানে দুপক্ষ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। দুই দলের শীর্ষ নেতারা রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে একমত হন উল্লেখ করে পিএমএল-এনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক সহযোগিতার জন্য নেতারা একমত হয়েছেন।’
ওই বৈঠকের পর পিএমএল-এন ও পিপিপি একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে বলে জিও নিউজ জানিয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পিএমএল-এন প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে পিএমএল-এনের একটি প্রতিনিধিদল পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি ও কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে বৈঠকে সরকার গঠনে তাদের সহযোগিতা চেয়েছেন। জবাবে পিপিপি নেতৃত্ব পিএমএল-এন নেতাদের বলেছেন, প্রস্তাবটি নিয়ে তাদের দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির (সিইসি) বৈঠকে আলোচনা করা হবে। আজ সোমবার ওই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘বৈঠকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পিএমএল-এন ও পিপিপি রাজনৈতিক সহযোগিতার নীতিতে একমত হয়েছে। উভয়পক্ষ দেশকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে রক্ষায় একমত হয়েছে।’
সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা জোগাড় নিয়ে এ দেনদরবারের মধ্যে পিটিআইর সমর্থন নিয়ে জয়লাভ করা স্বতন্ত্র প্রার্থী ওয়াসিম কাদির পিএমএল-এনে যোগ দিয়েছেন।
পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় পরিষদে ২৬৫ আসনের মধ্যে পিটিআইয়ের সমর্থন নিয়ে জয়লাভ করা স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন ৯৩ জন। দল হিসেবে পিএমএল-এনের সর্বোচ্চ ৭৫ প্রার্থী জয়লাভ করেছেন এবং পিপিপির জয় পেয়েছে ৫৪ জন। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএমপি) পেয়েছে ১৭টি আসন, মাওলানা ফজলুর রেহমানের জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম (জেইউআই-এফ) পেয়েছে ৪টি। বাকি আসনগুলো অন্যান্য দল পেয়েছে।
এদিকে পিটিআইয়ের একজন সাধারণ সম্পাদক গতকাল প্রাথমিক ফলের নথিপত্রের ওপর ভিত্তি করে দাবি করেন, জাতীয় পরিষদের ১৮ আসনের ফল পরিবর্তন করা হয়েছে, যেখানে পিটিআই প্রার্থীরা জয়লাভ করেছিলেন। এসব আসনের ফল নিয়ে আদালতে যাবেন পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা।
সরকার গঠন করতে হলে দলগুলোকে ১৩৪টির মতো আসনে জয়লাভ করতে হতো। কিন্তু কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করায় জোট গঠন অপরিহার্য।
পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের খবর, আসিফ আলি জারদারি তার ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করেছেন। দলীয় সভায় নিজ কর্মীদের উদ্দেশে এমন কথা বলেছেন শাহবাজ শরিফ।
সরকার গঠন ইস্যুতে গতকাল এমকিউএমপির প্রধান খালিদ মকবুল সিদ্দিকির সঙ্গে বৈঠক হয় পিএমএল-এন নেতৃত্বের। দুই দল সরকার গঠনের একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে বলে পিএমএল-এনের তরফে বিবৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু এমকিউএমপি এ-সংক্রান্ত অঙ্গীকার নাকচ করে দিয়ে বলে, সরকার গঠনের কোনো সমঝোতা নওয়াজের দলের সঙ্গে হয়নি। এ নির্বাচনে এমকিউএমপি বেশ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্কের আসনে জলয়াভ করেছে, যা সরকার গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০১৮ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে এমকিউএম তার অংশীদার হয়।
নওয়াজ শরিফ নির্বাচনের ফল ঘোষণার মাঝে বলেছিলেন, তিনি সরকার গঠন করতে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এমনকি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গেও তিনি কথা বলতে রাজি আছেন বলে জানান। গতকাল পূর্ণ ফল ঘোষণার পরই পিটিআইয়ের সমর্থন নিয়ে পাঞ্জাবের লাহোরের জাতীয় পরিষদের একটি আসন থেকে জয়লাভ করা প্রার্থী ওয়াসিম কাদির পিএমএল-এনে যোগ দিয়েছেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাড়িতে ফিরলাম।’
সরকার গঠনের জন্য পরিকল্পনা কীভাবে এগিয়ে নিচ্ছে পিটিআই নেতৃত্ব তা এখনো পরিষ্কার নয়। দলটির কর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনে কারচুপি ও ফল ঘোষণায় বিলম্বের প্রতিবাদে লাহোর, করাচি, পেশোয়ারসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করেন। এ সময় বেশ কয়েকজন পিটিআই সমর্থককে আটক করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। স্বতন্ত্র প্রার্থীর দলত্যাগ নিয়ে পিটিআই নেতৃত্ব বলছে, আনুগত্য পরিত্যাগ করে বিশ্বাসঘাতকতা করা কাউকেই মানুষ গ্রহণ করে না, যা ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে।
ইমরান খান কারাগারে বন্দি থাকায় বর্তমানে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন ব্যারিস্টার গহর আলি খান। তিনি বেশ আগেই জানিয়ে দেন, তার দল পিপিপি বা পিএমএল-এন এদের কারও সঙ্গে জোট সরকার গড়তে আগ্রহী নয়। গতকাল একই কথা তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি এও বলেন, দলের নির্বাচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ অটুট রয়েছে।
ব্যারিস্টার গহর আরও বলেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান কেন্দ্রসহ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার সরকার গঠন করতে যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছেন। পিটিআই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবে আইনসভায় বসে। আইনসভার বাইরে বসে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ‘তাদের (পিএমএল-এন-পিপিপি) সঙ্গে সরকার গঠনের চেয়ে বিরোধী দলের আসনে বসা শ্রেয়।’
শেষ পর্যন্ত ইমরান খানের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা একজোট হয়ে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে পিএমএল-এন ও পিপিপির জোট সরকারই হয়তো ভবিষ্যতে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসবে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তাই হয়ে যাচ্ছে বড় প্রশ্ন। অনেকে বলছেন, সম্ভবত দরকষাকষিতে পিপিপি নেতৃত্ব বিলাওয়ালকে প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে দেখতে চাইছেন। পিএমএল-এন সর্বোচ্চ আসনে জয়লাভ করেও প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়বে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। এর বাইরে প্রাদেশিক পরিষদের আলোচনা এখনো সেভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় নেই। সবার নজর জাতীয় পরিষদে।
এমন জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে পিটিআই ঠিক কোন ফর্মুলায় সরকার গড়তে চাইছে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যারিস্টার গহর। তিনি জানান, ইমরান খানের নির্দেশনায় পিটিআই মজলিস-ওয়াহদাত-ই-মুসলিমিন (এমডব্লিউএম) দলের সঙ্গে জোট গঠন করবে। এই দলের সঙ্গে জোট গঠন করে পিটিআই সমর্থিত জয়ীরা একটি মোর্চা তৈরি করবেন, যার ফলে জাতীয় পরিষদের সংরক্ষিত আসনগুলো দখল করার সম্ভাবনা তৈরি করা যাবে।
পিটিআইয়ের মুখপাত্র রউফ হাসান জানান, তার দলের সঙ্গে এমডব্লিউএমের সমঝোতা হয়েছে। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পাশাপাশি পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় সরকার গঠনের চেষ্টা চালানো হবে।
পিটিআই দাবি করছে, তাদের হাত থেকে ৬০টির মতো আসন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব নিয়ে পরবর্তী আইনি লড়াই চালানো হবে।
এমটিআই