ঢাকা : গত দশকের মাঝপথে দুর্নীতি মামলার কারণে আজীবন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়ে যুক্তরাজ্য পাড়ি জমান পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর ‘মধুচন্দ্রিমা’ শেষের পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের আগে নওয়াজকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। দেশে-বিদেশে সর্বমহলের কাছে বস্তুত দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ছিল, নওয়াজকে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় বসাতে মরিয়া। তবে ভোটের পর ইমরানপন্থিদের অবিস্মরণীয় জয়ের পর জোট রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহে নিজেকে প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড় থেকে সরিয়ে নিয়েছেন নওয়াজ। কিন্তু কেন...এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নানা সমীকরণ মিলিয়ে দেখছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলো।
ইমরান খানকে অনাস্থা ভোটে হারানোর পর জোট সরকারের নেতৃত্ব দেন নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফ। ভাইয়ের প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ভোটের ফল ঘোষণার পর নানা সময় তিনি বলেছেন, পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) দলের প্রধান নওয়াজ শরিফকে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে মুখিয়ে রয়েছেন তিনি।
এ নির্বাচনে ইমরানপন্থি স্বাধীন প্রার্থীরা সর্বোচ্চ ৯৩ আসনে জয় পেলেও দল হিসেবে সর্বোচ্চ আসন পাওয়া পিএমএল-এন সরকার গঠনে ভুট্টো পরিবারের দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এবং অন্যান্য দলের দ্বারস্থ হয়েছে, যারা পেয়েছে ৫৪ আসন। গত মঙ্গলবার রাজধানী ইসলামাবাদে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-কায়েদে আজম (পিএমএল-কিউ) প্রধান চৌধুরী সুজাতের বাসভবনে মিলিত হন শাহবাজ, পিপিপির কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলি জারদারিসহ এমকিউএম-পি, আইপিপি ও অন্যান্য দলের নেতারা। পরে সংবাদ সম্মেলনে জোট সরকার গঠনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। পিপিপি চেয়ারম্যান আসিফ আলি জারদারি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
এর কিছুক্ষণ পরই নওয়াজকন্যা মরিয়ম নওয়াজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান, শাহবাজ হচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি নিজে হচ্ছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। নওয়াজ তাদের পর্দার আড়াল থেকে নির্দেশনা দেবেন।
কেন নওয়াজ শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ালেনশ্ব বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পাকিস্তানি সাংবাদিক রিজওয়ান শেহজাদ বলেন, ‘নির্বাচনী জনরায়ের বিভক্তি, শেষ মুহূর্তে তার ভাই শাহবাজের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে নতুন একটি রাজনৈতিক ভূমিকায় দেখা ছাড়া বিকল্প কিছু খুঁজে পাননি নওয়াজ।’ নওয়াজের নিজের অবস্থানের ব্যাপারটি কেমন হতে পারেশ্ব এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মরিয়ম। তিনি বলেন, নওয়াজ দলের ‘নির্বাচক’ বা ‘মনোনয়নকারীর’ ভূমিকায় থাকবেন, যিনি পর্দার আড়াল থেকে ভূমিকা রাখবেন।
এদিকে শাহবাজকে প্রধানমন্ত্রী করে সম্ভাব্য নতুন সরকারের ঘোষণাকে ‘জনরায় চুরির’ সঙ্গে তুলনা করেছে পিটিআই।
ওই সংবাদ সম্মেলনের সঙ্গেও নওয়াজের সিদ্ধান্তের যোগসূত্র খোঁজা হচ্ছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন না বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি। আবার বাবা আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে তার বেশ কিছু মতভেদও পরিষ্কার হয় সংবাদ সম্মেলনে। তার অনুপস্থিতির সঙ্গে কি নওয়াজের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক রয়েছেশ্ব এমন জল্পনা এখন পাকিস্তান জুড়ে।
পিএমএল-এনের নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে কানাঘুষা রয়েছে। তবে এ নিয়ে কেউই প্রকাশ্যে কথা বলছেন না। অন্তত গতকাল বুধবার পর্যন্ত পরিস্থিতি তেমনই। অনেকে বলছেন, নওয়াজের এ সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চিত কোনো জটিলতা রয়েছে। এ সিদ্ধান্ত আপনা-আপনি আসেনি।
নওয়াজের ওপর থেকে যখন একের পর এক আইনি ঝামেলা উঠে যাচ্ছিল এবং তার বিরুদ্ধে থাকা মামলা খারিজ হচ্ছিল; ওই সময় অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী পদে নাও দেখা যেতে পারে নওয়াজকে। তখন আরও বলা হচ্ছিল, শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে পিপিপি, পিএমএল-এন, জেইউআই-এফ এবং অন্যান্য দল নিয়ে গঠিত পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) জোট সরকারের প্রথম দফার শাসন আরও এক দফা আসতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, চৌধুরী সুজাতের বাসায় একমাত্র জেইউআই-এফ ছাড়া পিডিএম সরকারের প্রধান প্রধান শরিকরা ছিল। বরং আরও কিছু দল বেড়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মোড় সেই দিকেই।
এখন দ্বিতীয় দফায় পিডিএম বা সেই ধরনের কোনো জোট সরকারের গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে পাকিস্তানের গণমাধ্যম ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ বলছে, শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বর্তমান এস্টাবলিশমেন্ট (সামরিক বাহিনী) নেতৃত্বের সম্পর্ক উষ্ণ। নওয়াজের বদলে শাহবাজকেই নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করার নির্দেশনা তারাই দিতে পারে।
২০১৮ সালে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সর্বোচ্চ আসনে জয়লাভ করে জোট সরকার গঠন করে তিন বছরেরও বেশি ক্ষমতায় থাকার পর পিডিএম জোটের কাছে আস্থা ভোটে হেরে যায়। ওই সময় শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকার নিয়ে ভোটের আগে বহুবার কথা বলেছেন বিলাওয়াল। তিনি বলতেন, ‘তিনি বাবাদের (বড়দের) রাজনীতি আর চান না।’ কিন্তু সর্বশেষ জোটপ্রক্রিয়াকে পিডিএম জোটের সম্প্রসারণ বললে একদমই ভুল হয় না।
আবার ওই সংবাদ সম্মেলন হওয়ার আগে ইসলামাবাদে আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে বিলাওয়াল জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ চান না, তবে তার দল পদটির জন্য পিএমএল-এনের প্রার্থীকে সমর্থন করবে। আবার তিনি এ-ও জানান, পিপিপি নতুন সরকারের অংশ হবে না।
কিন্তু চৌধুরী সুজাতের বাসার সংবাদ সম্মেলনে জানা যায়, পিপিপি নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগদান করবে। অবশ্য দ্বিতীয় পর্যায় থেকে অংশগ্রহণের কথা জানা গেছে।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বাবা আর ছেলের বিরোধের কোনো সমীকরণ থাকতে পারে। এতে নওয়াজের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করার সংকটও লুকিয়ে থাকতে পারে। কারণ নির্বাচনের আগে নওয়াজকে সেনাবাহিনীর ‘নতুন প্রিয়পাত্র’ আখ্যা দিয়েছিলেন বিলাওয়াল। আবার নওয়াজকে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী করতে এস্টাবলিশমেন্ট যে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে, এমন কথা কয়েকবার বলেছেন বিলাওয়াল।
আবার পাকিস্তানের জিওটিভির একটি অনুষ্ঠানে গত মঙ্গলবার রাতের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলা হয়, ‘শাহবাজের নেতৃত্বে জোট সরকারের প্রতি সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিপিপি। বিলাওয়ালের সংবাদ সম্মেলনে এর প্রতিফলন রয়েছে।’
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিএমএল-এন নেতা রানা সানাউল্লাহ ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন। ওই সময় তিনি বলেন, শাহবাজ শরিফের সে রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং এমন কিছু হলে তাতে অন্য দলগুলোর যোগ দেওয়া উচিত।
এদিকে নতুন এক সংকট এসেছে পিটিআইয়ের সামনে। ধারণা করা হচ্ছিল, মজলিস ওয়াহদাত-ই-মুসলিমিন (এমডব্লিউএম) দলের সঙ্গে স্বাধীন প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়া ব্যক্তিরা যোগ দিলে সংরক্ষিত আসনগুলো দখল করতে পারবে পিটিআই। তবে এখন শঙ্কা তৈরি হয়েছে, আইনি জটিলতা দেখিয়ে পিটিআইকে হয়তো এসব আসন থেকে বঞ্চিত করা হতে পারে।
গতকাল পিটিআই চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গহর আলি খান বলেন, নির্বাচন কমিশন আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পিটিআইকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করতে যাচ্ছে।
এমটিআই