ঢাকা : ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর পেরিয়ে গেলো, কিন্তু সহসাই এ যুদ্ধ থামবে এমন কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। না ইউক্রেন না রাশিয়া, না তাদের কোনো মিত্র, কারও পক্ষ থেকেই শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো চিহ্ন নেই।
কিয়েভ এ ব্যাপারে একরোখা যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তাদের যে সীমানা রয়েছে, রাশিয়ান সৈন্যদের হটিয়ে তা রক্ষিত রাখতে হবে। অন্যদিকে, তাদের ইউক্রেনকে যথাযথ রাষ্ট্র নয় দাবি করে লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে চায় রাশিয়া।
জেতার সম্ভাবনা কার?
শীতকালজুড়ে তীব্র মুখোমুখি লড়াইয়ে, দুই পক্ষেরই বেশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন প্রায় ১০০০ কিলোমিটার জুড়ে ও ২০২২ সালের শরতের পর থেকে এই এলাকায় খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।
দুই বছর আগে রাশিয়ার পুরো মাত্রার সামরিক অভিযান শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ান সৈন্যদের রাজধানী কিয়েভ ও উত্তরাঞ্চল থেকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। ওই বছরের শেষদিকে তারা পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলেও দখল করা বড় এলাকা উদ্ধার করে। কিন্তু এই মূহুর্তে রাশিয়া শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, আর ইউক্রেনীয়রা বলছে যে তাদের গোলা বারুদ ফুরিয়ে আসছে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চলা পূর্বাঞ্চলের আভডিভকা শহর থেকে নিজেদের সৈন্যদের সরিয়ে নেয় ইউক্রেন। যেটাকে একটা বড় বিজয় হিসেবে দেখছে রাশিয়া। কণ কৌশলগতভাবে আভডিভকা শহরটি আরও ভেতরে অভিযানের পথ খুলে দিতে পারে।
কিয়েভ জানায়, তারা সৈন্যদের জীবন রক্ষা করতেই তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া তাদের অস্ত্র ও সৈন্য সংখ্যা যে সেখানে অনেক কম ছিল সেটাও তারা লুকায়নি। গত বছরের মে মাসে বাখমুত দখলের পর এটাই ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বিজয়। কিন্তু আভডিভকা উত্তর-পশ্চিমের দোনেৎস্ক থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে, ইউক্রেনের যে শহরটি ২০১৪ সাল থেকেই রাশিয়ার দখলে রয়েছে।
তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে লক্ষ্য নিয়ে রাশিয়া অভিযান শুরু করে, মিলিটারি ব্লগার ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা প্রচারণায় বলা হয় মাত্র ‘তিন দিনের মধ্যেই’ রাজধানী কিয়েভ দখল করা হবে, সেই তুলনায় এটা খুবই সামান্য অগ্রগতি। বর্তমানে ইউক্রেনের ১৮ শতাংশ অঞ্চল রুশ শক্তির নিয়ন্ত্রণে, যার মধ্যে ২০১৪ সালের মার্চে দখল করা ক্রিমিয়া ও দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের বিরাট অংশও রয়েছে।
ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন কি কমে আসছে?
গত দুই বছর ধরে মিত্ররা ইউক্রেনকে প্রচুর পরিমাণ সামরিক, আর্থিক ও মানবিক সাহায্য দিয়ে আসছে। কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির হিসাবে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৯২ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ২০০ কোটি ডলার এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। আর ৭৩ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ৩০০ কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
পশ্চিমাদের সরবরাহ করা ট্যাংক, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও দূরপাল্লার আর্টিলারি ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সহায়তার পরিমাণ অনেক কমে গেছে ও ইউক্রেনকে আদতে কতদিন তাদের মিত্ররা সহায়তা চালিয়ে যেতে পারবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে, এই মুহূর্তে ইউক্রেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও চাপের মধ্যে রয়েছে। সামনেই দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তার আগে ইউক্রেনের জন্য বাইডেন সরকারের নতুন ৬০ বিলিয়ন বা ৬ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘরোয়া রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে কংগ্রেসে আটকে রয়েছে।
আর ইউক্রেনের সমর্থকদের মধ্যে শঙ্কা ভর করেছে যে যদি নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে যান, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা থমকে যাবে।
এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফেব্রুয়ারিতে নানা আলোচনা ও হাঙ্গেরির সঙ্গে দর কষাকষির পর ৫৪ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার মূল্যের সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া ইইউ মার্চের মধ্যে ইউক্রেনকে যে পরিমাণ আর্টিলারি সরবরাহ করতে চেয়েছে, সেটার অর্ধেক দিতে পারবে।
রাশিয়ার সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিবেশি বেলারুশ, যাদের বিভিন্ন এলাকা ও আকাশপথ ব্যবহার করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে রুশ সৈন্যরা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বলছে, ইরান রাশিয়াকে শাহেদ ড্রোন সরবরাহ করছে। যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়াকে অল্প কিছু ড্রোন দিয়েছে বলে স্বীকার করেছিল ইরান।
আবার পশ্চিমা দেশগুলো যেভাবে চেয়েছিলো, তাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার বহর রাশিয়ার উপর সেভাবে কাজ করেনি। রাশিয়া এখনো যেমন তেল বিক্রি করতে সমর্থ হচ্ছে, তেমনি তাদের সামরিক শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও অন্য দেশ থেকে আনতে পারছে।
চীন অবশ্য কোনো দেশকেই অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে না। তারা যুদ্ধ ঘিরে খুবই সতর্কভাবে তাদের কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা রাশিয়াকে হামলার জন্য নিন্দাও করছে না, আবার মস্কোর সেনাবাহিনীকে সমর্থনও দিচ্ছে না। যদিও চীন ও ভারত রাশিয়া থেকে নিয়মিত তেল কিনে চলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশই উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছেও ধর্না দিয়েছে। সমর্থন পাওয়ার জন্য দেশ দুটির প্রতিনিধিরা আফ্রিকা মহাদেশ ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে নিয়মিত কূটনৈতিক সফর করছেন।
রাশিয়ার লক্ষ্য কি বদলে গেছে?
এখনো বেশিরভাগের বিশ্বাস যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পুরো ইউক্রেন পেতে চান। যুক্তরাষ্ট্রের টক শো উপস্থাপক টাকার কার্লসনের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ ব্যাপারে তার মতামত তুলে ধরেন।
তার দাবি, ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে, পূর্বে দনবাস অঞ্চলের মানুষরা রাশিয়ার শাসনে থাকতে চায়। যুদ্ধের আগে পুতিন একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন, যেখানে তিনি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে বলেন, রাশিয়ান ও ইউক্রেনিয়ানরা আসলে একই জনগোষ্ঠী।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, তাদের ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ লক্ষ্য বদল হয়নি। তিনি ইউক্রেনকে চরম ডানপন্থী প্রভাব থেকে বের করে আনতে চান। একই সঙ্গে পুতিন বলেন, ইউক্রেনের ‘সামরিক বাহিনী বিলুপ্ত’ করে একটি ‘নিরপেক্ষ’ দেশ হিসেবে দেখতে চান তিনি। একই সঙ্গে এই অঞ্চলে ন্যাটো যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে এই অঞ্চলে সেটার বিরোধিতা করেন তিনি।
একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেন কখনোই কোনো সামরিক জোটে ছিল না। তাদের যে রাজনৈতিক লক্ষ্য ইইউতে যোগদান ও ন্যাটোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা অর্জনে যে আলোচনা চলছিল, এই দুটো বিষয়েরই সফলতা যুদ্ধ শুরুর পর এখন অনেক বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
যুদ্ধ কীভাবে শেষ হতে পারে?
যেহেতু কোনো দেশই খুব সহজে পরাজয় স্বীকার করে নেবে না এবং আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিনই আবার ক্ষমতায় থাকবেন বলে মনে হচ্ছে, তাই যুদ্ধ আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে বলে অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গ্লোবসেক বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাব্য ফলাফল পর্যালোচনা করেছে। সেটাতে সবচেয়ে বেশি যা উঠে এসেছে, তা হলো- ২০২৫ সালেরও বেশি সময় পর্যন্ত যুদ্ধটা দীর্ঘায়িত হবে, যাতে দুই পক্ষেরই প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটবে ও ইউক্রেন মিত্রদের অস্ত্র সহায়তার উপর নির্ভর করে থাকবে।
আর দ্বিতীয় সম্ভাব্য ফলাফল হলো- বিশ্বের অন্যান্য অংশেও সংঘাত বাড়বে, যেমন মধ্যপ্রাচ্য, চীন-তাইওয়ান ও বলকানদের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা ছড়াবে।
আরও যে দুটি সম্ভাব্য ফলের কথা উঠে এসেছে, যেগুলোর সম্ভাবনা খুবই সামান্য। তার একটা হলো- ইউক্রেন সামরিক দিক থেকে কিছুটা অগ্রসর হবে, কিন্তু যুদ্ধে শেষ করার মতো পরিস্থিতিতে যেতে পারবে না। অথবা, ইউক্রেনের মিত্রদের সমর্থন ফুরিয়ে আসবে ও তারা কিয়েভকে সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে।
তবে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কী হয় ও একই সঙ্গে অন্যান্য যুদ্ধ বিশেষত ইসরায়েল-হামাস সংঘাত কোনদিকে গড়ায় ও সেটা ইউক্রেন-রাশিয়ার মিত্রদের কীভাবে প্রভাবিত করে, সেসবের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
যুদ্ধ কি আরও ছড়াতে পারে?
এই ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সতর্ক করে বলেন, ইউক্রেনকে ‘কৃত্রিম অস্ত্র সংকটের’ মধ্যে ফেলে রাখলে তাতে লাভবান হবে রাশিয়া। মিউনিখের নিরাপত্তা সম্মেলনে তিনি বলেন, যদি পশ্চিমা দেশগুলো তার পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে পুতিন আগামী কয়েক বছরে বিশ্বের আরও অনেক দেশের জন্যই ‘বিপর্যয়’ বয়ে নিয়ে আসবেন।
দ্য রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি) থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বলছে, রাশিয়া খুব সফলভাবে তাদের অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা শিল্পে সাময়িক ধাক্কা সামলে নিয়েছে। তাছাড়া সামরিক উৎপাদন বাড়িয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতও হয়েছে মস্কো।
ইউরোপীয় দেশের মধ্যে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও এস্তোনিয়ার গোয়েন্দা বিভাগও সম্প্রতি শঙ্কা প্রকাশ করেছে যে আগামী দশকের মধ্যেই রাশিয়া ন্যাটোর যে কোনো সদস্য রাষ্ট্রে হামলা করে বসতে পারে। এই শঙ্কা ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নতুন করে ভবিষ্যৎ ভাবনায় ফেলেছে। সূত্র- বিবিসি
এমটিআই