• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

এক সময়ের পুলিশ কর্মকর্তাই এখন গ্যাং লিডার


আন্তর্জাতিক ডেস্ক মার্চ ১৮, ২০২৪, ১০:১৯ এএম
এক সময়ের পুলিশ কর্মকর্তাই এখন গ্যাং লিডার

ঢাকা: আরও একবার সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হলেন হাইতির গ্যাং লিডার (সন্ত্রাসী দলের নেতা) জিমি ‘বারবিকিউ’ চেরিজিয়ের।

ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ হাইতির রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ক্রমে বেড়ে চলেছে সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। 

এর পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা রয়েছে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা ও তাঁর সন্ত্রাসী জোট ‘জি৯ ফ্যামিলি অ্যান্ড অ্যালাইস’-এর।

জিমি চেরিজিয়েরের গ্যাং জোটের সদস্যরা জ্বালানি টার্মিনাল অবরুদ্ধ করেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী সন্ত্রাসী দলগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার দখল পাকাপোক্ত করতে সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এতে হাইতির হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

আবার অতিসম্প্রতি পোর্ট-অ-প্রিন্সে নতুন করে শুরু হওয়া ব্যাপক সহিংসতার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তি হিসেবেও উঠে এসেছে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের নিষেধাজ্ঞায় থাকা জিমি চেরিজিয়েরের নাম। হাইতির প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরির পদত্যাগ দাবি করেছেন তিনি।

চলতি মার্চের শুরুতে চেরিজিয়ের হুঁশিয়ার করে বলেছেন, অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হেনরি পদত্যাগ না করলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে।

হানাহানি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে প্রধানমন্ত্রী হেনরি চলতি সপ্তাহে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন। বলেছেন, ক্যারিকমের (ক্যারিবিয়ান কমিউনিটি অ্যান্ড কমন মার্কেট) দেশগুলোর রূপরেখা মেনে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিল গঠন ও তার অন্তর্বর্তী উত্তরসূরি বাছাই হলে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করবেন তিনি।

তবে এ ঘোষণা গ্যাং সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ থেকে রাজধানীকে উদ্ধারে তেমন কাজে আসেনি। পোর্ট-অ-প্রিন্সের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের হাতে।

হাইতির ব্যাপারে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপও নাকচ করে দিয়েছেন চেরিজিয়ের। এর মধ্যে রয়েছে দেশটিতে গ্যাং সহিংসতা মোকাবিলায় সহায়তা করতে জাতিসংঘ-সমর্থিত ও কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার বিষয়ও।

জিমি চেরিজিয়েরের গ্যাং জোটের সদস্যরা জ্বালানি টার্মিনাল অবরুদ্ধ করেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী সন্ত্রাসী দলগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার দখল পাকাপোক্ত করতে সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এতে হাইতির হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

চেরিজিয়েরের অতীত 
হাইতির জাতীয় পুলিশ বাহিনীর (এইচএনপি) একজন সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন চেরিজিয়ের। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, তিনি নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার ঘটনায় যুক্ত।

হাইতিতে ২০২১ সালে নিহত হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোয়েস। এতে দেশের শাসনক্ষমতায় এক শূন্যতা তৈরি হয়। ওই সময় থেকে রাজধানী পোর্ট–অ–প্রিন্সজুড়ে দেখা দেয় সহিংসতা। আর তাতে জড়িত ছিল চেরিজিয়েরের জি৯ গ্যাং জোট।

এ গ্যাং জোটের সদস্যদের মাধ্যমে বিশেষ করে রাজধানীর উপকণ্ঠে দরিদ্র সাইট সোলেইল এলাকায় সংঘটিত নানা অপরাধ নিয়ে গত বছর কিছু তথ্য প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

উদাহরণ হিসেবে ২০২৩ সালের এপ্রিলের এক ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, ব্রুকলিন এলাকার জোসেফিন নামে একজন নারী বাসিন্দা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, তিনি তার বোনের সঙ্গে বাড়িতে হাঁটছিলেন। এ সময় দুর্বৃত্তরা এসে থামায় তাঁকে।

জোসেফিন বলেন, অপরাধীরা এ সময় কিছু লোককে জড়ো করে তাদের সবার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে তাদের মধ্যে কয়েকজন পুরুষের শরীর কেটে ফেলে।’ এইচআরডব্লিউ বলেছে, জোসেফিন ও তার বোন জি৯ সদস্যদের কাছে একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। পরে জোসেফিন তার ভাইকে মৃত অবস্থায় পান।

হাইতিতে গত কয়েক বছর ধরে চলা সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ও বারবার দেখা দেওয়া সমস্যাগুলোর একটি তীব্র জ্বালানি ঘাটতি। এর পেছনে চেরিজিয়েরের নেতৃত্বাধীন শক্তিশালী গ্যাং জোটকে দায়ী করেছেন জাতিসংঘ। ২০২২ সালে রাজধানীর একটি প্রধান জ্বালানি টার্মিনাল অবরোধ করেন গ্যাং সদস্যরা। এতে হাসপাতালগুলো পরিষেবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া ওই ঘটনা পুরো দেশকে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।

এ নিয়ে এক বছর আগে গ্যাং নেতা চেরিজিয়ের বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হেনরিকে পদত্যাগে বাধ্য করানোই ছিল জ্বালানি টার্মিনাল অবরোধের ওই কৌশলের লক্ষ্য।

২০২১ সালের অক্টোবরে চেরিজিয়েরের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল আল-জাজিরা। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এরিয়েল হেনরি ৮টায় পদত্যাগ করলে, ৮টা ৫ মিনিটে আমরা সব প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলব;  যাতে ট্রাকগুলো টার্মিনালে আসতে ও জ্বালানি ভর্তি করতে পারে। এরপর সংকটেরও সমাধান হবে।’

ওই বছরের জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোয়েস নিহত হলে দেশের ক্ষমতায় আসেন হেনরি। দীর্ঘ সময় হেনরি পশ্চিমা দেশের সমর্থন পান। তবে হাইতির বিভিন্ন নাগরিক অধিকার সংগঠন বিশেষ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রেসিডেন্ট ও আইনসভার নির্বাচন বাতিল করার পর তাঁর ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

স্বঘোষিত বিপ্লবী
চেরিজিয়ের নিজেকে একজন বিপ্লবী হিসেবে উপস্থাপন করেন; যিনি দেশকে নিয়ন্ত্রণ করা অভিজাত সম্প্রদায় ও অসম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

সাক্ষাৎকারে জিমি চেরিজিয়ের বলেছিলেন, ‘আমরা অন্য এক সমাজ, অন্য এক হাইতির জন্য লড়াই করছি; যেখানে মাত্র ৫ শতাংশ লোকের হাতে সব সম্পদ থাকবে না। বরং নতুন এই হাইতিতে সব মানুষ খাবার ও সুপেয় পানি পাবেন, বসবাস করার জন্য তাদের থাকবে সুন্দর বাড়ি। এটি হবে ভিন্ন এক হাইতি; যেখানে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে না আমাদের।’

ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার হাইতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ রবার্ট ফ্যাট্টনের মতে, চেরিজিয়ের দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তির নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বা কিউবার দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে পছন্দ করেন।

গত সপ্তাহে অধ্যাপক রবার্ট ফ্যাট্টন আল জাজিরাকে বলেন, ‘মূলত চেরিজিয়ের নিজেকে একজন বিপ্লবী এবং তিনি সম্পদের পুনর্বণ্টন করতে চলেছেন-এমন একজন নেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চান। জি৯ গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার লোকজনের মধ্যে চেরিজিয়ের কিছু খাবার ও সম্পদ বিতরণ করেছেন। কিন্তু এটি খুব সামান্যই তার ভবিষ্যৎ দর্শন বা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন।’

ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার এই শিক্ষক আরও উল্লেখ করেন, হাইতির রাজধানীতে অব্যাহত সহিংসতার সবচেয়ে বেশি শিকার হলেন, খুবই দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা। আর তারা থাকেন বড় বড় বস্তিতে। সহিংসতার কবলে পড়ে রাজধানী থেকে প্রায় ২ লাখের বেশি বাসিন্দা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। তাদের খুবই সাধারণ মানের শিবিরে থাকতে হচ্ছে। অন্য কথায়, এসব মানুষকেই সাহায্য করতে চান চেরিজিয়ের।

জিমি ‘বারবিকিউ’ চেরিজিয়ের

‘আমি গ্যাংস্টার নই’
চেরিজিয়েরের বিরুদ্ধে নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ সেই তখন থেকেই, যখন তিনি পুলিশ বাহিনীর সদস্য ছিলেন।

জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ২০১৮ সালে রাজধানী পোর্ট–অ–প্রিন্সের উপকণ্ঠে লা স্যালিন এলাকায় হামলা– সহিংসতায় কয়েক ডজন মানুষ মারা যান। চেরিজিয়ের তাতে যুক্ত ছিলেন। সে সময় হাইতির জাতীয় পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন তিনি।  

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ‘রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে’ হাইতির সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় গ্যাং সদস্যদের মধ্যে সংঘটিত হয় ওই হামলা-সংঘর্ষ। এতে অন্তত ৭১ জন নিহত হন, ধ্বংস হয় চার শতাধিক বাড়িঘর এবং সশস্ত্র গ্যাং সদস্যদের ধর্ষণের শিকার হন অন্তত সাত নারী। পরে চেরিজিয়েরের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর, ২০১৭ সালে পোর্ট-অ-প্রিন্সের গ্র্যান্ড র‍েভাইন এলাকায় পুলিশের এক অভিযানে বেসামরিক লোকজনকে মেরে ফেলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে চেরিজিয়েরের বিরুদ্ধে। এরপর ২০১৮ সালের শেষ দিকে পুলিশ বাহিনী থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এর কয়েক মাস পর তার বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।

চেরিজিয়ের তার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ২০২১ সালে আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো গ্যাংস্টার (গুন্ডাপ্রধান) নই। আমি কখনোই তা হবো না। আমি এখনকার শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ছি। তাঁদের হাতে অনেক অর্থ। তাদের আছে মিডিয়া। তারা আমাকে গ্যাংস্টারের মতো করে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।’

এআর

Wordbridge School
Link copied!