ঢাকা : ভারতীয় নৌবাহিনী আরব সাগরে অভিযান চালিয়ে এমভি রুয়েন নামের যে জাহাজটি উদ্ধার করেছে, সেটি ছিনিয়ে নেওয়ার পর সোমালি জলদস্যুরা ৫০০ কোটি রুপি সমমানের মুক্তিপণ দাবি করেছিল।
মুম্বাই পুলিশের বরাত দিয়ে রোববার (২৪ মার্চ) এ খবর প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস।
প্রায় এক দশক সুপ্ত থাকার পর লোহিত সাগরে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য আবার বেড়েছে। এডেন উপসাগর এবং আরব সাগরের উত্তরাঞ্চলে সামরিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ভারত। ওই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র পথে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় তাদের দমনে ভারতীয় নৌবাহিনী সমুদ্রে জলদস্যু দমন অভিযান শুরু করেছে।
সেই অভিযানের অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে তারা মাল্টার পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ এমভি রুয়েন জব্দ করে এবং সেটিতে থাকা ১৭ জন ক্রুকে উদ্ধার করে।
১৫ মার্চ আরব সাগরে শুরু হওয়া সেই রুদ্ধশ্বাস অভিযান শেষ হয় ৪০ ঘণ্টা পর। ওই জাহাজ দখল করে রাখা ৩৫ সোমালি জলদস্যুকে আটক করে শনিবার মুম্বাই পৌঁছায় ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ আইএনএস কলকাতা। পরে দস্যুদের মুম্বাই পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মুম্বাই পুলিশের বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, ১৭ জন নাবিকসহ বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি রুয়েন ছিনিয়ে নেওয়ার পর জলদস্যুরা জাহাজটির মালিকদের টেলিফোন করে মুক্তিপণ বাবদ ৫০০ কোটি রুপি সমমানের অর্থ মুক্তিপণ দাবি করেছিল।
গত বছরের ডিসেম্বরে এমভি রুয়েন নামের জাহাজটি ছিনিয়ে নেয় সোমালি জলদস্যুরা। তারপর তারা সেটিকে সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যায়। জাহাজটি মাল্টায় নিবন্ধিত হলেও এর মালিক বুলগেরিয়ার একটি কোম্পানি।
এমভি রুয়েন মুক্ত হলেও বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এখনও জলদস্যুদের কব্জায়। গত ১২ মার্চ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরের সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে জাহাজটি। জাহাজের ২৩ নাবিক এখন জলদস্যুদের হাতে জিম্মি।
জাহাজটির মালিক চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের কোম্পানি এস আর শিপিং। জাহাজ ছিনতাই হওয়ার ৯ দিনের মাথায় গত বুধবার দুপুরে তারা জানায়, জলদস্যুরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে। এরপর একাধিকবার জলদস্যুদের সঙ্গে এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষের যোগাযোগ হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
তবে কয়লা ভর্তি ওই জাহাজ এবং ২৩ নাবিকের জন্য মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে কিনা, কিংবা মুক্তিপণের অংকটি কত সে বিষয়ে এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।
এর মধ্যে শুক্রবার সোমালিয়ার পান্টল্যান্ডের নুগাল অঞ্চলের পুলিশ বিভাগের কমান্ডারের বরাত দিয়ে বিবিসি সোমালি জানায়, সাগরে থাকা এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাইকারী জলদস্যুদের সাথে ভূমির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে তারা একটি অভিযান শুরু করেছে।
সোমালিয়ার আধা-স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডের নুগাল এলাকার পুলিশ বিভাগের কমান্ডার মোহাম্মদ আলী আহমেদ মারদুউফ এমভি আবদুল্লাহর সর্বশেষ অবস্থান জিফল উপকূলে জানিয়ে বিবিসি সোমলিকে বলেন, জাহাজে থাকা জলদস্যুদের হাতে এখন দুটি বিকল্প আছে। হয় তাদের পান্টল্যান্ডের কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে কৃতকর্মের জন্য প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে।
অথবা আগের জাহাজ অর্থাৎ এমভি রুয়েনকে যেমন বিদেশি বাহিনী ধরে নিয়ে জলদস্যুদের তাদের দেশে নিয়ে গেছে, সেই পথে যেতে হবে।
পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে দস্যুতা মোকাবেলায় কাজ করা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স (ইইউএনএভিএফওআর) বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জানায়, তাদের আটলান্টা অপারেশনের অংশ হিসেবে একটি যুদ্ধজাহাজ তারা এমভি আবদুল্লাহর কাছে মোতায়েন করেছে।
এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ শুরু থেকেই জাহাজে কোনো ধরনের অভিযান চালানোর বিরোধিতা করে আসছে। ১৪ বছর আগে তাদের আরেক জাহাজ এমভি জাহান মণিকে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মুক্তিপণ দিয়ে এবারও তারা নাবিকসহ জাহাজটি নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে চায়।
কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পার্সন মিজানুল ইসলাম বলেন, জাহাজের নাবিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে তারা কোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপে সমর্থন করেন না। বাংলাদেশ সরকারেরও ‘একই চাওয়া’।
কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এমভি জাহান মণি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল ২০১০ সালে। মুক্তিপণ দিয়ে ১০০দিন পর জাহাজিটি ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।
তখনকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, এমভি জাহাজ মণি এবং এর ২৫ নাবিকসহ জাহাজটিতে থাকা মোট ২৬ জনের মুক্তিপণ বাবদ ৯ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছিল। জলদস্যুদের সাথে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দেন দরবার শেষে মুক্তিপণ হিসেবে ৪ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলার এবং জাহাজের জ্বালানি খরচ হিসেবে আরো ১ লাখ ডলার জলদস্যুদের দেওয়া হয়েছিল। যা ডলারের বর্তমান বিনিময় হারে ৫২ কোটি টাকার মত।
এমভি আবদুল্লাহ যখন জলদস্যুদের কবলে পড়ে, তখন জাহাজটির অবস্থান ছিল সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে। জাহাজটি আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পেয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ আইএনএস তর্কশ গত ১৪ মার্চ সকালে এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি পৌঁছায়। কিন্তু নাবিকরা সশস্ত্র জলদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকায় সে সময় অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকেন ভারতীয় নৌ সেনারা।
ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তায় থাকা ইউরোপীয় নেভাল ফোর্সও আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাতে সায় দেয়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম জানিয়েছিলেন।
ইইউএনএভিএফওআর বলছে, এমভি রুয়েনকে কব্জা করার পর জলদস্যুরা ওই জাহাজ নিয়ে সাগরে ঘুরে ঘুরে অন্য নৌযানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে আসছিল। এমভি আবদুল্লাহকে ছিনিয়ে নেওয়ার কাজেও এমভি রুয়েনকে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে বলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্সের ধারণা।
হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, এমভি রুয়েন থেকে আটক ৩৫ জলদস্যুকে নিয়ে শনিবার মুম্বাই পৌঁছানোর পর নেভাল ডকইয়ার্ডে তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে মুম্বাই পুলিশের বন্দর অঞ্চলের ডেপুটি কমিশনার সঞ্জয় লাটকার জানান।
তিনি বলেন, আইএনএস কলকাতার রেগুলেটিং অফিসার অজয় কুমারের করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ভিত্তিতে একটি মামলায় আমরা জলদস্যুদের গ্রেপ্তার করেছি।
ভারতের ২০২২ সালের মেরিটাইম অ্যান্টি-পাইরেসি অ্যাক্ট, ১৯৬৭ সালের বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন এবং ১৯৫৯ সালের অস্ত্র আইনের বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে গ্রেপ্তার সোমালি জলদস্যুদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, চাঁদবাজি, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, অন্যায়ভাবে আটকে রাখা, হত্যাচেষ্টা এবং অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তা সঞ্জয় লাটকার জানান, গ্রেপ্তার জলদস্যুদের সঙ্গে কথা বলার জন্য তারা সোমালি ভাষা জানা একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ করবেন। কারণ জলদস্যুরা সোমালি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানে না।
জলদস্যুদের পাশাপাশি দুটি ছোট নৌকা, তিনটি ইঞ্জিন, নয়টি মোবাইল ফোন, ১৯৬টি কার্তুজ, একটি ছুরি, একটি ক্যামেরা এবং গ্রেপ্তার জলদস্যুদের কয়েকজনের পাসপোর্টও পুলিশের কাছে জমা দিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী।
এমটিআই