ঢাকা : ইরান-ইসরায়েল। একে অপরের প্রতি চরম বৈরি দুই দেশ। সম্প্রতি ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বৈরিতা আরও বেড়েছে দুই দেশের। এছাড়া সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে হামলা ও জেনারেল নিহতের ঘটনায় ইসরায়েলে প্রথমবারের মত সরাসরি হামলা চালিয়েছে ইরান।
তাই বর্তমানে নতুন করে শংকা দেখা দিয়েছে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ কি অবশেষে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে?
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের প্রধান সহায়তাকারী হচ্ছে ইরান। এখন প্রশ্ন হল, ইরান কি সত্যিই এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে? আর দুই দেশের মধ্যে চরম বৈরি সম্পর্কই বা কেন তৈরি হলো?
তবে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইরান-ইসরায়েল বর্তমানে পরস্পরের শত্রু দেশ হলেও, অতীতে কিন্তু পরিস্থিতি এমনটা ছিলো না।
অতীতে বন্ধু
জানলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন, একসময় এই ইরান এবং ইসরায়েল ছিলো একে অপরের বন্ধু। এমনকি ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশ ছিলো ইরান।
ইরান ১৯৫০ সালে ইসরায়েলকে এই স্বীকৃতি দেয়।
এরপর ক্রমে দুই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক, এমনকি সামরিক সম্পর্কও। এরপর ১৯৫৭ সালে যখন ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘সাভাক’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এতে সহায়তা করেছিলো ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।
ইসরায়েলের সঙ্গে ইরান সম্পর্ক ধরে রাখায় মনযোগী হয় মূলত মার্কিন সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য।
বন্ধুত্ব থেকে বৈরিতা
ইরানের সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেও ইরানের ভেতরে আগে থেকেই ইসরায়েল বিরোধিতা ছিলো।
ইরানের শাহ শাসন বিরোধী বামপন্থীদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন ফাতাহ এবং এর নেতা ইয়াসির আরাফাতের যোগাযোগ ছিলো। অন্যদিকে, আয়াতুল্লাহ খোমেনী এবং তার অনুসারীরাও ছিলেন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে।
তবে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়ে মূলত ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর।
তখন ক্ষমতায় আসা ইরানের বিপ্লবী সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেয়ার ঘোষণা দেয় এবং তেহরানে ইসরায়েলের দূতাবাসকে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে পরিণত করে। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
মূলত ইরানের বিপ্লবী সরকার ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে।
অন্য আরব দেশগুলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানে একমত হলেও ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী সেটা গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তারা ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে অস্বীকারের নীতি নেয়।
অন্যদিকে ইরানের এমন উত্থানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে ইসরায়েল।
সম্পর্ক যেভাবে আরো খারাপ হলো
ইরানের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক দিন দিন বৈরী হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। তার মধ্যে প্রথমত, ইরানের দূরপাল্লার মিসাইল তৈরির চেষ্টা এবং দ্বিতীয়ত, পরমাণু প্রকল্প গ্রহণ।
তার প্রতি বৈরি হয়ে পড়া ইরানের এমন দুটি সামরিক প্রকল্পকে হুমকি হিসেবে দেখেছে ইসরায়েল। ফলে তারা ইরানের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিশেষত পরমাণু প্রকল্প ভেস্তে দিতে শুরু করে নানা অন্তর্ঘাতমূলত পদক্ষেপ।
এসময় দেশটির একের পর এক বিজ্ঞানীকে ইসরায়েল হত্যা করেছে বলেই ইরানের অভিযোগ। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার প্রভাব বলয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়।
লেবাননে ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় গড়ে ওঠে হেজবুল্লাহ। নব্বইয়ের দশকে হামাস এবং ইসলামিক জিহাদকেও সহায়তা করতে শুরু করে ইসরায়েল।
ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং ইসরায়েল একধরনের আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেটা দুই দেশের সম্পর্ককে আরো খারাপের দিকেই নিয়ে যায় বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।
ইসরায়েল কেন ইরানকে হুমকি মনে করে?
ইসরায়েল ইরানের অস্ত্র কর্মসূচিকে সবসময়ই হুমকি হিসেবে দেখে এসেছে। এমনকি ইসরায়েল ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা করার হুমকিও দিয়েছে একাধিকবার। এমনকি এবারও ইসরায়েলে ইরানের হামলার পর ইরানের পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রগুলোতে ইসরায়েলের পাল্টা হামলার শংকা করছে অনেকে।
যদিও ইরান দাবি করে তাদের পরমাণু কর্মসূচি অস্ত্র বানানোর জন্য নয়, বরং শান্তিপূর্ণ। কিন্তু সামরিকভাবে ইরানের চেয়ে শক্তিশালী এবং আমেরিকা-ইউরোপের সমর্থন সত্ত্বেও ইসরায়েল কেন ইরানকে হুমকি মনে করে? ইরান কি আসলেই ইসরায়েলের জন্য হুমকি?
ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক তেমনটাই মনে করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি ইসরায়েলের ছোট আয়তনের কথা বলছেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ইরান ইসরায়েলের চেয়ে আয়তনে অনেক বড়। এর জনসংখ্যাও ইসরায়েলের দশ গুন বেশি। ফলে ইরানকে একটা যুদ্ধের মাধ্যমে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, কিন্তু একটা বড় যুদ্ধে অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য ইসরায়েল বেশ ছোট দেশ। এর জনসংখ্যাও কম। এছাড়া ইসরায়েলের মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম আছে, কিন্তু সেটা ইরানের সর্বাত্মক মিসাইল হামলা ঠেকানোর মতো নয়।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ইরানের মতো একটা দেশ যখন ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার ঘোষণা দেয়, এবং সে দেশ যদি পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে ফেলে তাহলে এই ভয় থাকবেই যে সে এটা কোন একদিন ব্যবহার করলেও করতে পারে, বলছেন মেইর লিটভ্যাক।
ইসরায়েল-ইরান পরস্পর বৈরি দেশ এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সাম্প্রতিক হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনায় পশ্চিমা দেশগুলোসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশও মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পরার শংকায় রয়েছে। আর তাই বার বার যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে এই দুই দেশকে।
এমটিআই