• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

চিকন সুতায় ঝুলছে জর্ডান, ইসরায়েলকে সাহায্য ছাড়া উপায় কী?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক এপ্রিল ১৭, ২০২৪, ০৬:২৫ পিএম
চিকন সুতায় ঝুলছে জর্ডান, ইসরায়েলকে সাহায্য ছাড়া উপায় কী?

ঢাকা: ইসরায়েল ইস্যুতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরব দেশ জর্ডানের ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি বেশ কৌতূহল তৈরি হয়েছে। ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র থেকে ইসরায়েলকে রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে জর্ডানও।

যদিও এক বিবৃতিতে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বলেছেন, তারা নিজের দেশকে রক্ষার জন্যই ইরানি ড্রোন ভূপাতিত করেছেন, ইসরায়েলকে সাহায্য করার জন্য নয়।

জর্ডানের এই বিবৃতিকে ‘ভারসাম্য রক্ষার’ বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলছেন, হামাস, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যে সংঘাত চলছে সেখানে ‘ক্রসফায়ারে’ পড়তে চায় না জর্ডান।

এ কথা ঠিক যে জর্ডানের রাজতন্ত্রের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ২৫ বছর ধরে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ। পর্দার আড়ালে জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কও একেবারে খারাপ নয়।

‘জর্ডান প্রমাণ করতে চেয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ভালো সহযোগী। কিন্তু এ বিষয়টি নেতানিয়াহুর কাছ থেকে আশা করবেন না। গাজায় হামলা বন্ধ এবং পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে উসকানি বন্ধ করার জন্য আম্মানের আহ্বানে সাড়া দেবে না ইসরায়েল,' এক্স প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক এমিলি হোকায়েম।

তবে ভিন্ন যুক্তিও রয়েছে। ভৌগোলিকভাবে জর্ডানের অবস্থান এমন একটি জায়গায়, যেখানে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে জর্ডানের ওপর।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুদ মোস্তাজাবি লিখেছেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এই উত্তেজনা যদি পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে এখন যাদের ইসরায়েলের রক্ষাকর্তা বলে মনে করা হচ্ছে, তারাও একসময় আক্রান্ত হবে এবং সেই যুদ্ধে তাদেরও টেনে আনা হবে।

মোস্তাজাবি নিজেও জর্ডানের নাগরিক। তিনি লিখেছেন, জর্ডানে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থী, ভঙ্গুর অর্থনীতি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান– এসব কিছুই তাদের জন্য চিন্তার কারণ।

জর্ডান-ইসরায়েল স্বার্থ
১৯৯৪ সালে জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি হয়, যার মাধ্যমে জর্ডান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়।

ইসরায়েলি সংবাদপত্র ‘টাইমস অব ইসরায়েল' এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে পানিচুক্তি নবায়নের জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানায় জর্ডান। কিন্তু এর বিপরীতে জর্ডানকে পাল্টা শর্ত বেঁধে দেয় ইসরায়েল।

তাদের শর্ত হচ্ছে, গাজা ইস্যুতে জর্ডান যেন খুব বেশি শক্ত অবস্থান না নিয়ে তাদের অবস্থান নরম করে।

২০২২ সালের নভেম্বর মাসে আরেকটি চুক্তির আওতায় জর্ডান ইসরায়েলের কাছে সৌর বিদ্যুৎ রপ্তানি করছে।

পর্যবেক্ষকের অনেকেই বলছেন, জর্ডান প্রকৃতপক্ষে একটি ‘চিকন সুতার’ ওপর দিয়ে হাঁটছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের কৌশলগত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। কারণ, আর্থিকভাবে দুর্বল দেশ জর্ডান নানা ধরনের সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল।

অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা। কারণ, জর্ডানের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ফিলিস্তিনি শরণার্থী।

দ্য ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি’র সিনিয়র ফেলো ঘাইথ আল-ওমারি দ্য টাইমস অব ইসরায়েলকে বলেন, কয়েক বছর ধরে ইরান চেষ্টা করছে জর্ডানের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে। যেমনটি তারা করেছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়েমেনের ক্ষেত্রে। এসব দেশে ইরানের এক ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব তৈরি হয়েছে। ফলে দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে গেছে। ইরান চেষ্টা করছে জর্ডানেও তাদের সে ধরনের প্রভাব তৈরি করতে।

‘ইসরায়েল যদি জর্ডানের আকাশসীমা ব্যবহার করে ইরানে আক্রমণ করে, তাহলে সেটিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ইরান জর্ডানেও হামলা করতে পারে। এ বিষয়টি নিয়ে জর্ডান চিন্তিত,’ লিখেছেন আল-ওমারি।

তিনি আরও বলেন, জর্ডান এবং ইসরায়েলের মধ্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক উত্তেজনা সত্ত্বেও সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা কখনো থেমে থাকেনি।

১৯৯৪ সালে জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি চুক্তির পর থেকে দুই দেশের মধ্যে শক্ত নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা তৈরি হয়েছে। মুসলিমদের পবিত্র এলাকা আল-আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের মুতওয়াল্লি বা কাস্টোডিয়ান হচ্ছে জর্ডান।

শান্তিচুক্তি অনুযায়ী মাল্টি বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের মাধ্যমে জর্ডানে গ্যাস ও পানি সরবরাহ করে ইসরায়েল। পৃথিবীর যেসব দেশে পানির তীব্র সংকট রয়েছে তার মধ্যে জর্ডান অন্যতম। দেশটি চারপাশ থেকে স্থলসীমা বেষ্টিত।

ইতিহাস কী বলে?
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মোট চারটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে জর্ডান। ১৯৯৪ সালে জর্ডান এবং ইসরায়েলের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ‘ইউএন রিলিফ এন্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রেফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্ট’- এর হিসেবে মতে জর্ডানে প্রায় ২২ লাখ নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি শরণার্থী রয়েছেন। কিন্তু নিবন্ধনের বাইরেও আরও অনেক ফিলিস্তিনি শরণার্থী জর্ডানে অবস্থান করছেন। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা তার চেয়ে বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

১৯৫১ সালে জর্ডানের তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহকে জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে প্রবেশের সময় গুলি করে হত্যা করা হয়। একজন ফিলিস্তিনি আরব এই হত্যাকারী ছিলেন।

বাদশাহ আবদুল্লাহকে ফিলিস্তিনিদের অনেকেই পছন্দ করতেন না। এর একটি বড় কারণ ছিল প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে ফিলিস্তিন নিয়ে তার ভূমিকা।

শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালে জর্ডানের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করেছিল ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরা।

যদিও প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে কয়েকটি প্রতিবেশী আরব দেশের দেশের সঙ্গে মিলে জর্ডানও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। জর্ডান যুদ্ধে অংশ নিলেও ভেতরে ভেতরে ইসরায়েলের সঙ্গে আঁতাত করেন বাদশাহ আবদুল্লাহ।

প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর ১৯৫০ সালে জর্ডান তাদের সীমান্তের সঙ্গে থাকা ফিলিস্তিনি কিছু ভূখণ্ডকে জর্ডানের অন্তর্ভুক্ত করে। বাদশাহ আবদুল্লাহ’র এই পদক্ষেপ পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থন দিলেও ফিলিস্তিনিরা মানতে পারেননি।

বাদশাহ আবদুল্লাহকে হত্যার পর মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’র গোপন প্রতিবেদনে তাকে ব্রিটেন-পন্থি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। সিআইএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাদশাহ আবদুল্লাহ’র হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্টবিরোধী এবং পশ্চিমাপন্থি একজন শাসকের অবসান হলো।

তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জর্ডানের কোনো আগ্রহ ছিলনা। তখন জর্ডানের বাদশা ছিলেন হুসেইন।

তার নীতি ছিল আরব জাতীয়তাবাদ এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সহাবস্থানের। যদিও ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল সংকট নিয়ে জর্ডান ইসরায়েলের বিরুদ্ধাচরণ করলেও পরবর্তীতে ইসরায়েলের ব্যাপারে তিনি অনেকটা বাস্তববাদী অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে জর্ডানের বাদশা হুসেইন গোপনে আলোচনা শুরু করেন ইসরায়েলি নেতাদের সঙ্গে।

ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ আভি শ্লেইম 'ওয়ার এন্ড পিস ইন দ্য মিডল ইস্ট' বইতে লিখেছেন, ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল যখন জর্ডানে হামলা চালায়, তখন জর্ডানও এই যুদ্ধে জড়িয়ে যায়।

ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা দুটি রাষ্ট্র গঠনের যে প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়েছিল সেটিকে একমাত্র আরব দেশ হিসেবে সমর্থন দিয়েছিল জর্ডান। সেটির বিনিময়ে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ অন্যান্য আরব ভূমি তাদের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন।

সেন্টার ফর ইসরায়েল এডুকেশন বলছে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কিছুদিন আগে তৎকালীন প্রভাবশালী ইহুদি নেতা গোল্ডা মেইর আম্মানে গিয়ে গোপনে বৈঠক করেছিলেন জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে।

প্রথম আরব ইসরায়েল যুদ্ধের পর জর্ডান আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের জর্ডানের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।

সেন্টার ফর ইসরায়েল এডুকেশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এর আগে ইসরায়েল এবং জর্ডানের মধ্যে বেশ কিছু গোপন বৈঠক হয় যুদ্ধবিরতি নিয়ে। তখন আরব লীগের অন্যান্য দেশ জর্ডানের এসব কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি।

১৯৬৭ সালে তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আগপর্যন্ত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সে যুদ্ধের পর এসব অঞ্চল ইসরায়েল দখল করে নেয়।

এরপর ২০ বছর ধরে জর্ডান চেষ্টা চালিয়েছিল পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম ফেরত পেতে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৮ জর্ডান পশ্চিম তীরের ওপর থেকে তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে এবং বিষয়টি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের ওপর ছেড়ে দেয়। কিন্তু জর্ডান পূর্ব জেরুজালেমের ওপর প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছিল। তবে তাতে তারা সফল হয়নি।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

আইএ

Wordbridge School
Link copied!