ঢাকা : রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের চীন সফরকে ঘিরে সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তবে পুতিনের চীন সফরের পেছনে ভিন্ন ভিন্ন এক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে দাবি করেছেন বিশ্ব রাজনীতির বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি, ইউক্রেনে হামলার কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে অনেকটাই রাশিয়া বিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। এ সময় তার শক্তি প্রদর্শন করাটা জরুরী ছিল। তাই পুতিন চীন সফর করে বিশ্বকে দেখাতে চাইছেন তার পাশেও বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র চীন রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে পুতিনের চীন সফর ছিল পুরোটাই অর্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি চাইছিলেন রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের সহায়তা। রুশ নেতার সঙ্গে যাওয়া ব্যক্তিবর্গকে দেখে বেইজিং সফরে তাঁর প্রত্যাশা সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পুতিনের সঙ্গে ছিল রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, তাঁর অর্থমন্ত্রী ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা।
চীনের সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরে জানা গেছে, সফরে চীন অতিথি পুতিনকে ভালোভাবেই স্বাগত জানিয়েছেন। দেওয়া হয়েছে লালগালিচা সংবর্ধনা। বাদক দল বাজিয়েছে পুরোনো রেড আর্মির গান। তিয়েনআনমেন স্কয়ার দিয়ে যখন দুই নেতা যাচ্ছিলেন, তখন ছোট শিশুরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল। একে অপরকে জড়িয়ে ক্যামেরার সামনে ছবিও তুলেছেন সি ও পুতিন।
পুতিন চীন সফরে আগ্রহ ছিল, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা ও একঘরে হয়ে পড়া রাশিয়ার সঙ্গে চীন যেন ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যায়। তাই পুতিন চীন ও শি জিনপিংকে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত প্রশংসার ফুল ঝরিয়েছেন। পুতিন শি জিনপিংকে বলেন, তার পরিবার মান্দারিন ভাষা (চীনা ভাষা) শিখছে। এটি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো বিষয়। কেননা, নিজ সন্তানদের বিষয়ে প্রকাশ্যে তার কথা বলা একেবারে বিরল ঘটনা।
রুশ নেতা ঘোষণা করেন, তিনি ও প্রেসিডেন্ট সি ‘এতটা ঘনিষ্ঠ, যেন ভাই-ভাই’। চীনের অর্থনীতির প্রশংসা করে পুতিন বলেন, ‘এটি দ্রুতগতি এগিয়ে চলেছে।’ তাঁর এ প্রশংসা দেশের অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে চিন্তায় থাকা বেইজিংয়ের কর্মকর্তাদের সম্ভবত সান্ত্বনার কাজ দেবে।
তবে পুতিনের এমন প্রশংসাকে কূটনৈতিকভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছে চীনের প্রেসিডেন্ট। ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়াকে একঘরে করেছে। অন্যদিকে পশ্চিমাদের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু বেইজিং রাশিয়ার মতো বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেনি, তা চায়ও না। কারণ প্রেসিডেন্ট শি জানেন, বিশ্বে এখন নেতৃত্ব দেওয়ার সময় তার।
তিনি ইঙ্গিত দেন, চীন দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। তাই সফরে পুতিনকে ঝংনানহাইয়ে নিজ সরকারি বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান শি। এই বাসভবনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়ে সম্মানিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন কম বিশ্বনেতাই। তাঁদের একজন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ২০১৪ সালে চীন-মার্কিন সম্পর্কের সবচেয়ে সুখের সময় চীন সফরে ওই বাসভবনে যান ওবামা।
এদিকে স্বাভাবিকভাবে পুতিনের এ সফরে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে চীন-রাশিয়া বাণিজ্য সম্পর্কের দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। বিবৃতিতে ১৩০ বার উল্লেখ করা হয়েছে ‘সহযোগিতা’ শব্দ। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শি’র মধ্যেও স্পষ্ট। একদিকে তিনি পুতিনের সঙ্গে জোট টিকিয়ে রাখতে চান, অন্যদিকে একঘরে রাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলে তা পশ্চিমা দেশের সঙ্গে তার দেশের স্থিতিশীল সম্পর্কে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে—সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে চান। চীনের মন্থর অর্থনীতি চাঙা করতে পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখা জরুরি, সেটা জানেন তিনি।
অবশ্য এ সবকিছুর ওপরই সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে উসকানি দেওয়া এবং দেশটির ড্রোন ও ট্যাংকে ব্যবহারের উপযোগী যন্ত্রাংশের সরবরাহ করা বিষয়ে চীনকে সতর্ক করে দেন।
পুতিনের বেইজিং সফর, তাকে জানানো অভ্যর্থনা ও সফর ঘিরে অন্যান্য আয়োজন নিশ্চিত করেই এ ইঙ্গিত দেয় যে শিপশ্চিমা চাপের কাছে ভেসে যাবেন না, সেটি প্রমাণ করতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে এমন ঐক্য প্রদর্শনের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে মস্কোর ব্যাপারে শি কত দূর যেতে প্রস্তুত, তা নিয়ে সীমাবদ্ধতার বিষয়টি।
সর্বোপরি চীনের স্বার্থ রাশিয়ার স্বার্থ নয়। দুই দেশের সম্পর্কের অংশীদারত্বে সি সম্ভবত ততক্ষণই সহযোগিতা করবেন, যতক্ষণ তা তার স্বার্থের সঙ্গে মানানসই হবে। এমনকি তাকে ‘প্রিয় বন্ধু’ ও মিত্র পুতিনের যতই প্রয়োজন হোক।
এমটিআই