• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
ইউরোপে ডানপন্থিদের উত্থান

কেন যুক্তরাজ্যে বামপন্থিদের জয়জয়কার?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জুলাই ৬, ২০২৪, ০৯:৪২ এএম
কেন যুক্তরাজ্যে বামপন্থিদের জয়জয়কার?

ঢাকা : গোটা ইউরোপ যখন ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে, সেখানে পাল্টা চিত্র দেখা গেল যুক্তরাজ্যের সাধারন নির্বাচনে। দেশটিতে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছে মধ্য-বামপন্থি লেবার পার্টি আর ডানপন্থি কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবি হয়েছে।

অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)গত মাসের নির্বাচনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে কট্টর-ডানপন্থি দলগুলো থেকে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী জয় পান। ডাপন্থিদের এই জোয়ারে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁর মধ্যপন্থি দল খারাপ ফল করায় এর জেরে তিনি জুনে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন ঘোষণা করেন।

এরপর গত সপ্তাহে ফ্রান্সে প্রথম দফা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়।কিন্তু তাতেও জয় পায় কট্টর ডানপন্থি ন্যাশনাল র‌্যালি। তাদের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে এরপর পার্লামেন্ট নির্বাচন থেকে শত শত প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেয় ফ্রান্সের বাম ও মধ্যপন্থি দলগুলো।

ওদিকে, নেদারল্যান্ডসে এ সপ্তাহে কট্টর ডানপন্থিদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। ইতালিতে যুদ্ধকালীন ফ্যাসিবাদী নেতা বেনিতো মুসোলিনির পর বর্তমানে সবচেয়ে ডানপন্থি নেতা ক্ষমতায় আছেন।

এই নির্বাচনী সাফল্য এবং ক্ষমতায় জনবাদী (পপুলিস্ট) ডানপন্থি নেতাদের উত্থান ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য এখন আর খুব একটা বিস্ময়কর কিছু নয়।

ইউরোপজুড়ে জনবাদী এই ডানপন্থিদের উত্থানের পেছনে নানা কারণ রয়েছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশই এখন অর্থনীতির শ্লথ গতি, অভিবাসনের উচ্চ হার, জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি এবং কার্বন-ডাই অক্সাই নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার মত বিভিন্ন সংকটে জর্জরিত।

জনবাদী রাজনীতিবিদরা প্রায়ই জাতীয় সংকটের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দোষারোপ করেন। এতে ইউরোপের দেশগুলোতে ইইউ নিয়ে বাড়তে থাকা নিন্দা-সমালোচনা (ইউরোস্কেপটিসিজম) আরও উস্কে ওঠে।

ফলে প্রশ্ন জাগে, ইউরোস্কেপটিসিজমের কারণে ইউরোপে এক মাত্র দেশ হিসাবে যুক্তরাজ্য যেখানে ইইউ সদস্যপদ নিয়ে গণভোটে পর্যন্ত গেল, সেই দেশই কেন এই প্রবণতার উল্টো পথে হাঁটল?

যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে জয়ের আগে লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার বলেছিলেন, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের দেখাতে হয়েছে যে, তারা জাতীয়তাবাদ এবং জনবাদের উত্থান থেকে শিক্ষা পেয়েছে। তার কথায়, আমাদেরকে যুক্তরাজ্য, ইউরোপ এবং বিশ্বকে দেখাতে হবে যে, আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে আছি তা একমাত্র প্রগতিশীলরাই মোকাবেলা করতে পারে।

তবে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে ভোটাররা যে ইউরোপীয় পপুলিজমের ঢেউয়ের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে তা নয়, বরং তারা পরিবর্তনের আকাঙ্খা থেকে এবং কনজারভেটিভ সরকারের অদক্ষতার শাস্তি দিতে তাদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য যুক্তরাজ্যের একসময় সুনাম ছিল। এরপর ২০১৬ সালে গণভোটে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কেবল সংকট আর সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। কোভিড মহামারী এবং জীবনযাত্রা ব্যয় সংকটে পর্যদুস্ত হয়েছে।

১৪ বছরের শাসনামলে কনজারভেটিভ (টোরি) পার্টি অনেক বেশি বেশি জনবাদী কর্মসূচি নিয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে অভিবাসন, আশ্রয়প্রার্থীদেরকে রুয়ান্ডায় পাঠানোর পরিকল্পনা। দলটি আরেকটি ঘোর ডানপন্থি, ইইউ-বিরোধী দল রিফর্ম ইউকে পার্টির চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়েছে।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রদপ্তরের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা পিটার রিকেটস বলেন, রাজনীতিতে চক্র আছে বলে তিনি মনে করেন এবং যুক্তরাজ্য তা থেকে বের হয়ে আসছে। ব্রেক্সিট ভোটের পর থেকে যে পপুলিস্ট ধাঁচের সরকার ছিল তা থেকে বের হয়ে আসছে তারা।

তিনি বলেন, এ ধরনের অনেক পপুলিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের শাসন করার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার প্রবণতা দেখা গেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। আর এখন সেই চক্র বদলাচ্ছে। অন্য দলগুলো শাসন পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ সরকার নানারকম কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পার্টিগেট কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে লিজ ট্রাসের ৪৪ দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে বিদায় নেওয়ার ঘটনায় আর্থিক বাজারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। পরে ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই জগাখিচুড়ি অবস্থা সামলানোর চেষ্টা করলেও ভাবমূর্তি পুরো বদলাতে পারেননি।

ফলে কনজারভেটিভদের নিয়ে ক্লান্তি এবং স্থিতিশীলতা ও ঐক্যের জন্য আকাঙ্খা দেখা গেছে ভোটারদের মাঝে। যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে যা দেখা যায় তা হচ্ছে, পেন্ডুলাম অন্যদিকে ঘুরতে বহু সময় লেগেছে। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্যও এ এক সতর্কবার্তা হয়ে এসেছে।

যদিও যুক্তরাজে্য একেবারে ডানপন্থার মৃত্যু ঘটেনি। নির্বাচনে লেবার পার্টি জয় পেলেও ফলাফল থেকে দেখা যায়, ব্রিটিশ ডানপন্থিরা এখনও যথেষ্ট সমর্থন পাচ্ছে। নাইজেল ফারাজের ডানপন্থি দল রিফর্ম ইউকে নির্বাচনে প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে।

এর আগের নির্বাচনে দলটির একটিও সংসদীয় আসন ছিল না। কিন্তু এবার ফারাজ নিজেই প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পেছনে অনেকটাই কৃতিত্ব ছিল তার।

নির্বাচনে কেবল আসনই জিতেননি ফারাজ, দলের সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি লেবার নেতা কিয়ার স্টারমারকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন এমনটিই ধারনা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। যদিও স্টারমারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার তুলনায় ফারাজের বিজয় তুলনামূলকভাবে নগণ্য। কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টির ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করতে পারেন ফারাজ। দলটিকে ভবিষ্যতে তিনি আরো ডানপন্থার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারেন।

যুক্তরাজ্যের এবারের নির্বাচনে একটি বিষয় হল, ফারাজের কারণে এবার ডানপন্থি ভোট ভাগ হয়ে সুবিধা পেয়েছেন লেবার নেতা স্টারমার।

তাছাড়া, লেবার পার্টি যেসব নির্বাচনী এলাকায় জয়ী হয়েছে সেখানে রিফর্ম ইউকে-এর শক্তিশালী অবস্থান দেখা গেছে নির্বাচনে। যার মানে, পার্লামেন্টে কট্টর-ডানপন্থিদের প্রভাব উপেক্ষা করা কঠিন। তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালীও হয়ে উঠতে পারে।

যুক্তরাজ্য অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো একই সংকটে ভুগছে। স্টারমার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সেই ডানপন্থতেই ব্রিটিশ জনগণেরও আগ্রহী হয়ে উঠার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!