• ঢাকা
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

যেভাবে যুক্তরাজ্যকে ‘পুনরাবিষ্কার’ করতে চান স্টারমার


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জুলাই ৬, ২০২৪, ০৯:৫১ এএম
যেভাবে যুক্তরাজ্যকে ‘পুনরাবিষ্কার’ করতে চান স্টারমার

ঢাকা : সাতাশ বছর পর চারশর বেশি আসনে জয় পাওয়া লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম ভাষণে যুক্তরাজ্যকে ‘পুনর্নির্মাণ’ ও ‘পুনরাবিষ্কার’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছ থেকে সরকার গঠনের অনুমতি নিয়ে সোজা ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে এসে সংবাদমাধ্যমকে নিজের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করতে গিয়ে এ ওয়াদা করেন ‘পরিবর্তনের ডাক’ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়া স্টারমার।

ডাউনিং স্ট্রিটে তার এসব কথাবার্তা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে ‘প্রথম ভাষণ’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।

ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দান আয়ারল্যান্ড নামে চার রাজ্য নিয়ে গঠিত যুক্তরাজ্যে বিরাজমান বহু সংকট ও সমস্যার মধ্যেই প্রথম ভাষণে রাষ্ট্র মেরামতের এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, কীভাবে তিনি তা করতে চান; এসব বিষয়ে এখন অনেকের কৌতূহল জন্ম নিচ্ছে।

বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, জাতির উদ্দেশে প্রথম বার্তায় কিয়ার স্টারমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে তার মনোযোগ দেখিয়েছেন, সেটি হল ‘অনিরাপদ বিশ্ব’। সেখানে তিনি যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের জন্য ‘নিরাপত্তা বিশ্ব’ দেওয়ার জন্য কাজ করার কথা বলেছেন।

যুক্তরাজ্যের ছয় কোটি ৭০ লাখ মানুষের মধ্যে অভিবাসন ও প্রবাসীর সংখ্যা নেহাত কম নয়, স্টারমার তার রাষ্ট্র পুনর্নিমাণের পরিকল্পনায় তাদের কতটা গুরুত্ব দেবেন, তাও পর্যবেক্ষণ থাকবে।

স্কাই নিউজ লিখেছে, লেবার পার্টির নিরঙ্কুশ জয়ও স্টারমারের ওপর প্রত্যাশার বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। সে চাপ মোকাবেলা করতে তাকে বিভিন্ন খাতে কর বাড়াতে হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের ৬৫০ আসনে বৃহস্পতিবার ভোটগ্রহণ হয়, শুক্রবার আসে ৬৪৮টি আসনের ফলাফল।

তাতে দেখা যাচ্ছে, লেবার পেয়েছে ৪১২টি আসন, কনজারভেটিভ ১২১টি, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস ৭১, স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি ৯টি এবং অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্ররা মিলে পেয়েছে ৩৯টি আসন।

ইনভারনিস এবং ওয়েস্ট রোজ-শায়ার আসনের ভোট পুনর্গণনা হবে শনিবার সকালে, তারপর সেখানের ফল ঘোষণা করা হবে।

‘পরিবর্তনের বার্তা’ দিয়ে বিপুল ভোটে জয় পাওয়ার পর যুক্তরাজ্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসস্থান বানানোর কথা বলছেন স্টারমার। আর সেজন্য নবগঠিত সরকারকে ‘সেবার সরকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় এসব নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আইন পাস করা এখন লেবারদের জন্য সহজ হবে।

সরকার গঠনের পরপরই স্টারমার কোন কোন দিকে মনোযোগ দিতে পারেন, সেসব বিষয়ে তুলে আনতে লেবার পার্টির নির্বাচনি ইশতেহারে গুরুত্বের শীর্ষে থাকা কিছু প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেছে বিবিসি। যুক্তরাজ্যকে পুনর্গঠন করতে স্টারমারকে এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

• আয়কর, জাতীয় বীমা স্কিম বা ভ্যাট না বাড়িয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।

• জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার অধীনে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষায় থাকা মানুষের সময় কমানো। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসাকর্মীদের প্রণোদনা দিয়ে কাজের সময় বাড়িয়ে প্রতিদিনি অতিরিক্ত ৪০ হাজার সেবাপ্রত্যাশীকে চিকিৎসার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে।

• পাচার চক্র ও মানব পাচার প্রতিরোধে সন্ত্রাসবিরোধী নিরাপত্তা ব্যবস্থার মত ক্ষমতা দিয়ে ‘সীমান্ত নিরাপত্তা কমান্ড’ গঠনের কথা বলা হয়েছে।

• নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে নতুন জনবল নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ‘গ্রেট ব্রিটিশ এনার্জি’কে যুগোপযোগী করতে চান স্টারমার।

• দেশ পুনর্গঠনের আরেক প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছে, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে সমাজবিরোধী আচরণ প্রতিরোধে ১৩ হাজার পুলিশ সদস্য ও সহায়ক কর্মী নিয়োগ দেবেন স্টারমার।

• দেশের জন্য নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে প্রাথমিক শিক্ষার দিকে বিশেষ মনোযোগ রয়েছে লেবার নেতার। নতুন প্রধানমন্ত্রী স্টারমার প্রাথমিক শিক্ষায় সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিতে এবং সব শিশুর জন্য বিনামূল্যে সকালের নাশতার ব্যবস্থা করতে চাইছেন।

জয়ের পর প্রথম ভাষণে দেশকে নতুন করে ‘আবিষ্কার’ করার কথাও বলেছেন স্টারমার। সেজন্য এখনই কাজ শুরুর কথা বললেও যুক্তরাজ্যের মানুষের কাছে ‘কিছুটা সময়ও’ চেয়েছেন তিনি। তার ভাষায়, দিনবদলের বিষয়টি ‘সুইচ চেপে বাতি জ্বালানো’র মত কোনো বিষয় নয়। এ জন্য কিছুটা অপেক্ষা করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

রয়টার্স-ইপসোসের জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে জীবনযাপন ও আবাসন খচর মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির মানুষ। বেশিরভাগ মানুষ ব্যয় কাঁটছাট করে ‘কায়দা করে’ দিন পার করার লড়াইয়ে ক্লান্ত। সেই ক্লান্তি থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষার চাপও এখন স্টারমারের কাঁধে।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম ভাষণে যেসব বিষয়ে দেশবাসীর কষ্ট লাঘবে কাজ করার কথা বলেছেন স্টারমার, তার মধ্যে আবাসন ও গৃহায়ণ এবং জ্বালানির মত জরুরি বিষয় রয়েছে।

• নতুন সুযোগ সৃষ্টির জন্য এমন অবকাঠামো নির্মাণ করতে চান স্টারমার, যেখানে শিক্ষা ও বাসস্থানের সঙ্কুলান হবে। এ কাজের প্রতিটি ইটে তিনি নজর রাখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

• সরকারকে ‘সেবার সরকার’ হিসেবে পরিচালনা করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে স্টারমার বলেছেন, এর মাধ্যমে পুরো জাতি নতুন করে পথচলা শুরু করবে।

• অনিশ্চিত বিশ্বের যেসব চ্যালেঞ্জ সেগুলো মোকাবিলার কথাও বলেছেন নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তার ভাষ্য- অনিরাদ বিশ্ব থেকে পূর্বে যেসব চ্যালেঞ্জ এসেছে, সে ধরনের কিছু হলে সেগুলো যুক্তরাজ্যের চার জাতি মিলে তা মোকাবিলা করবে।

জাতীয় কার্যপ্রণালীকে নবায়ন করে নিতে দেশের মানুষকে তার সরকারের সহযাত্রী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ৬১ বছর বয়সি স্টারমার বলেছেন, তিনি ‘প্রশান্তি ও সহনশীলতা’রও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন।

মধ্য বামপন্থি নেতা স্টারমার ভাষণে বলেন, যখন আমি লোকজনের কাছে শুনি, আপনাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য ব্রিটেন কি অন্যদের (দেশ) চেয়ে এগিয়ে আছে? অনেকে উত্তর দেন, ‘না’।

এ বিষয়ে তার বক্তব্য- যতক্ষণ না জনগণ আবার বিশ্বাস করছে যে, ব্রিটেন ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত দেশ, ততক্ষণ তিনি কাজ করে যাবেন।

যুক্তরাজ্যের ‘পুনর্গঠনের’ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে স্টারমার বলেছেন, জীবনের অধিতর নিরাপত্তার লাখ লাখ মানুষ তাদের অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তারা আশা দেখছেন।

রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি মানুষেরা ক্যামেরার আলো বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপেক্ষতি হয়ে যায় মন্তব্য করে স্টারমার বলেন, “আমি খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই- এবার আর তা হবে না।

আমি ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব, যত সময় আপনারা বিশ্বাস করছেন যে, সরকার তার কাজ করছে।

কথা দিয়ে নয়, কাজ দিয়ে অনাস্থা দূর করার প্রতিশ্রিুতি দিয়ে নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মঙ্গলের জন্য শক্তি হয়ে উঠতে পারে সরকার, আমরা সেটা দেখাব।

আমার লেবার পার্টিকে বদলে ফেলেছি, আবার ক্ষমতায় এসেছি; সে অনুযায়ী আমরা শাসন ব্যবস্থা সাজাব।

দেশের প্রত্যেক নাগরিকের প্রতি সরকার সম্মান দেখাবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন স্টারমার; তিনি বলেন, নতুন দিনের যাত্রায় এখন থেকেই কাজ শুরু করছেন।

যুক্তরাজ্যকে নবগঠিত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে চমৎকার স্বপ্ন স্টারমার দেখাচ্ছেন, তাতেও তিনি ডানপন্থিদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবেন বলে মনে হয় না।

উগ্র জাতীয়বাদী নেতা রিফর্ম ইউকে পার্টির নাইজেল ফারাজ অভিবাস আইন কঠোর করার জন্য তার কাজ চালিয়ে যাবেন বলে হুংকার দিয়ে রেখেছেন। তার মতে, যুক্তরাজ্যে কর্মসংস্থান, আবাসন ও জ্বালানি সংকট এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্য অভিবাসীরাই দায়ী।

ফারাজের চিন্তাধারার মানুষ ব্রিটেনে কম নয়, কারণ এবার তার দল ১৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে; তিনি নিজেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

অভিবাসন ইস্যুতে সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের রুয়ান্ডা পরিকল্পনা বাতিল করার প্রতিশ্রুতি লেবার পার্টির ইশতেহারে রয়েছে। তবে এরই মধ্যে রুয়ান্ডায় অভিবাসী পাঠানোর উদ্দেশে অবকাঠামো গড়ে তুলতে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ফেলেছেন ঋষি সুনাক। এই গচ্চা কীভাবে সামলাবেন স্টারমার, সেটাও দেখার বিষয়।

যুক্তরাজ্যের পুনর্গঠনের পরিকল্পনা নেওয়ার সময় স্টারমারকে হয়ত মাথায় রাখতে হবে, আসন বেশি পেলেও কত শতাংশ নাগরিক তার দলকে ভোট দিয়েছে।

আলজাজিরা লিখেছে, এবার লেবার পার্টি মাত্র ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়েই ৪১২ আসনে জিতেছে, যেখানে ২৪ শতাংশ ভোট নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে মাত্র ১২১টি আসন। ১২ শতাংশ ভোট গেছে লিব ডেমের ব্যালটে। তবে এর চেয়ে বেশি ১৪ শতাংশ ভোট পেলেও রিফর্ম ইউকে পেয়েছে চারটি আসন।

প্রাপ্ত ভোটের চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, কনজারভেটিভ, লিব ডেম ও রিফর্ম ইউকে মিলে ৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অন্যান্য দল মিলে বিরোধীদের ঘরে গেছে ৬৫ শতাংশ ভোট, যা লেবারের পাওয়া ৩৫ শতাংশ ভোটের প্রায় দ্বিগুণ। পরিসংখ্যানটি হয়ত ভাবাবে স্টারমারকে। ‘যা ইচ্ছা তাই করা’র সুযোগ নিলেই দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে পড়তে পারে।

সব কিছু মাথায় রেখে শুক্রবার বিকালে মন্ত্রিসভা গঠনে মন দেন স্টারমার। এরই মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন র‌্যাশেল রিভিস। তিনি যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী হলেন।

দায়িত্ব পাওয়ার পর রিভিস বলেছেন, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা তার জন্য সহজ হবে না। তবে তিনি খুবই আশাবাদী।

স্টারমারের মন্ত্রিসভায় বেশিরভাগ মুখই নতুন। ‘পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ’ নিয়েই কাজ করতে হবে অনভিজ্ঞ এই মন্ত্রীদের।

ফলে আইন-কানুনের বৈতরণী পার হওয়ার মত সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের নেতা হলেও রাজনৈতিক বৈতরণী পার হতে পদে পদেই চ্যালেঞ্জ থাকবে স্টারমারের জন্য। যে কারণে যুক্তরাজ্যকে মেরামতে তার যে প্রতিশ্রুতি, তা শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা জানতে হয়ত বছরদুয়েকের অপেক্ষা দরকার পড়বে।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!