ঢাকা : যুক্তরাজ্যের ভোটের লড়াইয়ে যে ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী ছিলেন, তাদের মধ্যে চারজনের মুখে জয়ের হাসি ফুটেছে।
তারা চারজনই সবশেষ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন, চারজনই লেবার পার্টির। আগের বার বিরোধী দলে থাকা এই চার এমপি এবার বসবেন সরকারি দলের আসনে। কেউ কেউ মন্ত্রিত্বও পেতে পারেন।
২০১৯ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী ছিলেন ১৪ জন। সেই হিসাবে এবার সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশি প্রার্থী থাকলেও নতুন কেউ জয় পাননি।
বৃহস্পতিবার দিনভর ভোটগ্রহণের পর গভীর রাতে আসা ফলে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৪১২টি পেয়েছে মধ্য বামপন্থি দল লেবার পার্টি। গত ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে মাত্র ১২১টি আসন।
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের এবারের নির্বাচনে ছোট-বড় মোট ৯৫টি রাজনৈতিক দল প্রার্থী দেয়। দেশটির ইতিহাসে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমনসের ৬৫০টি আসনের বিপরীতে এবারই সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৫১৫ জন প্রার্থী ভোট করেন।
ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম মিরর লিখেছে, এবার জাতীয় নির্বাচন এতটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে যে, এমন কোনো নির্বাচনি আসন নেই যেখানে অন্তত পাঁচজন প্রার্থী দাঁড়াননি। এমন একটি আসন রয়েছে, যেখানে সর্বাধিক ১৩ প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। এবার ৩১৭টি আসনে ৪৫৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোট করেন।
রুশনারা আলী: টানা পঞ্চমবারের মত লেবার পার্টি থেকে এমপি হয়েছেন সিলেটের মেয়ে রুশনারা আলী। তিনি প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ২০১০ সালে, লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ের মাধ্যমে।
এবার তার নির্বাচনি আসনের এলাকা কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। এর আগে তার নির্বাচনি এলাকা ছিল বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো, এবার সেটি বদলে করা হয়েছে বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড স্টেপনি।
রুশনারা পেয়েছেন ১৫ হাজার ৮৯৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক বাংলাদেশি আজমল মাসরুর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পেয়েছেন ১৪ হাজার ২০৭ ভোট। সুমন আহমেদ ও স্যাম উদ্দিন নামের আরও দুই বাংলাদেশি সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এছাড়া লিবারেল ডেমোক্র্যাট থেকে সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাবিনা খান।
টিউলিপ সিদ্দিক: উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট আসনে টানা চতুর্থবারের মত বিজয়ী হয়েছেন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক। কনজারভেটিভ পার্টির ডন উইলিয়ামসকে প্রায় ১৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ ২০১৫ সালে লেবার পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হন। পরের দফায় ২০১৭ সালের নির্বাচনে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন।
এরপর নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগেই ২০১৯ সালের শেষে যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন হয়। তাতে কনজারভেটিভ পার্টির জনি লুককে ১৪ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে হারান টিউলিপ।
বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর মেয়ে টিউলিপ লন্ডনের মিচামে জন্মগ্রহণ করেন। টিউলিপের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্মেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে।
এর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিরোধী দল লেবার পার্টির এমপি হিসাবে ছায়া সরকারে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করা টিউলিপ এবার লেবার সরকারের মন্ত্রী হতে পারেন বলেও জোর আলোচনা আছে।
রূপা হক: টানা চতুর্থবারের মত লেবার পার্টি থেকে পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে পাবনার মেয়ে রূপা হক, যার জন্ম ১৯৭২ সালে লন্ডনের ইলিংয়ে।
ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসন থেকে জয়ী রূপা লেবার পার্টির সদস্য হন ১৯৯১ সালে। তিনি একাধারে লেখক, মিউজিক ডিজে, কলামিস্ট হিসেবে পরিচিত।
এর আগে ২০০৫ সালের নির্বাচনে চেশাম ও এমারশাম আসন থেকে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেলেও নির্বাচিত হতে পারেননি তিনি। ২০০৪ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি।
আফসানা বেগম: লেবার পার্টির মনোনয়নে এবারও জয় পেয়েছেন আফসানা বেগম। ২০১৯ সালে পূর্ব লন্ডনের পপলার অ্যান্ড লাইমহাউস আসন থেকে লেবার পার্টির মনোনয়নে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন তিনি।
ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সোচ্চার ভূমিকা পালন এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন এমপি আফসানা বেগম।
আফসানার জন্ম ও বেড়ে ওঠা টাওয়ার হ্যামলেটসেই। বাংলাদেশে তার আদি বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। তিনি এবার পেয়েছেন ১৮ হাজার ৫৩৫ ভোট (৪৩.১ শতাংশ)। ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করা এহতেশামুল হক পেয়েছে ৪ হাজার ৫৫৪ ভোট।
বাকিদের চিত্র যেমন
লেবার পার্টি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুফিয়া আশরাফ লড়াই করেন সাউথ নর্থহ্যামটনশায়ারে। সেখানে ১৫ হাজার ৫০৪ ভোট পেয়ে তিনি দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন। কনজারভেটিভ পার্টির সারাহ বুল ১৯ হাজার ১৯১ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছেন।
গর্ডন অ্যান্ড বুশানে লেবার পার্টির প্রার্থী হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নুরুল হক আলী। পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান চতুর্থ, ভোট পেয়েছেন ৪ হাজার ৬৮৬ ভোট (১০.৭ শতাংশ)।
রুমি চৌধুরীকে লেবার পার্টি প্রার্থী করেছিল উইথাম আসনে। ১৩ হাজার ৬৮২ বা ২৭ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি হয়েছেন দ্বিতীয়। কনজারভেটিভ পার্টির প্রীতি প্যাটেল সেখানে ১৮ হাজার ৮২৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।
লেবার পার্টি থেকে নাজমুল হুসাইনকে প্রার্থিতার সুযোগ দেওয়া হয় ব্রিগ অ্যান্ড ইমিংহ্যামে। ১২ হাজার ৬৬২ ভোট পেয়ে তিনি হয়েছেন দ্বিতীয়। কনজারভেটিভ পার্টির মার্টিন ভিকারস সেখানে ১৫ হাজার ৯০৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।
ক্ষমতাসীন টোরি পাটি এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে দুজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশকে তাদের দলের প্রার্থী করে। যার মধ্যে টটেনহ্যাম থেকে দাঁড়িয়ে আতিক রহমান পেয়েছেন ২৩২০ ভোট, সেখানে ১০ প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান চতুর্থ।
কনজারভেটিভ পার্টি থেকে সৈয়দ সাইদুজ্জামান লড়াই করেন ইলফোর্ড সাউথে। আট প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান তৃতীয়, ভোট পেয়েছেন ৬ হাজার ১৪২ (১৪.৯ শতাংশ)। একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বাংলাদেশি নূর বেগম ৯ হাজার ৬৪৩ ভোট পেয়ে অর্জন করেছেন দ্বিতীয় অবস্থান। সেখানে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে লড়াই করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত গোলাম টিপু, যিনি ১৩৬৬ ভোট পেয়ে হয়েছেন ষষ্ঠ (৩.৩ শতাংশ)।
একই আসনে কট্টর জাতীয়তাবাদী দল রিফর্ম ইউকের প্রার্থী হয়ে লড়াই করেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি রাজ ফরহাদ। ২৩২৯ ভোট পেয়ে তিনি অর্জন করেছেন পঞ্চম অবস্থান। সেখানে গ্রিন পার্টি থেকে লড়াই করে সৈয়দ সিদ্দিকি পেয়েছেন ৩৪৩৭ ভোট, তার অবস্থান চতুর্থ।
ব্রিটেনের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বেডফোর্ডে লড়াই করেন প্রিন্স সাদিক চৌধুরী ৯৯৬ ভোট পেয়েছেন, সাত প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান তলানিতে।
একই দল থেকে হ্যাকনি সাউথে লড়াই করেন মোহাম্মদ শাহেদ হোসেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই প্রার্থী পেয়েছেন ১০০৭ ভোট, সাত প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান ষষ্ঠ।
ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে আলট্রিনশাম অ্যান্ড সেলে লড়াই করে ফয়সাল কবির পেয়েছেন ৬৪৩ ভোট। সেখানকার ছয় প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান সবার নিচে।
একই দল থেকে ম্যানচেস্টার রুশলমে লড়েছেন মোহাম্মদ বিলাল। তিনি পেয়েছেন ৩৬৬০ ভোট, সাত প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান তৃতীয়।
ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে স্টার্টফোর্ড অ্যান্ড বোতে লড়াই করেন হালিমা খান। সেখানে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, ৩২৭৪ ভোট পেয়ে হালিমা পেয়েছেন তৃতীয় অবস্থান। একই আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়াই করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ওমর ফারুক। ১৮২৬ ভোট পেয়ে তিনি অষ্টম স্থান অর্জন করেছেন। সেখানকার আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী বাংলাদেশি নিজাম আলী পেয়েছেন ২৩৮০ ভোট, তার অবস্থান পঞ্চম।
ডানফার্মলাইন অ্যান্ড ডলার আসন থেকে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির প্রার্থী হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক নাজ আনিস মিয়া। ১২ হাজার ৯৫ ভোট (২৭.২ শতাংশ) পেয়ে ৯ প্রার্থীর মধ্যে তিনি হয়েছেন দ্বিতীয়। সেখানে ২০ হাজার ৩৩৬ ভোট পেয়ে জয় পেয়েছেন লেবার পার্টির গ্র্যামি ডাউনি।
জলবায়ু সহনশীল যুক্তরাজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতিতে আসা গ্রিন পার্টি থেকে এবার তিনজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ভোটে লড়েন। ওল্ডহ্যাম ওয়েস্ট অ্যান্ড রয়টন থেকে শামসুজ্জামান শামস পেয়েছেন ১৮৫৭ ভোট, আট প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান ষষ্ঠ। তার আগের অবস্থানে আছেন বাংলাদেশি রাজা মিয়া। তিনি পেয়েছেন ২৪৭০ ভোট।
একই দল থেকে লেস্টারে লড়াই করেন শারমিন রহমান। পেয়েছেন ৩৮২৬ ভোট; ৯ জনের মধ্যে তার অবস্থান চতুর্থ।
ফোকস্টোন আসন থেকে স্যোশালিস্ট পার্টির প্রার্থী হন মমতাজ খানম। পেয়েছেন মাত্র ২৪৯ ভোট (.৬ শতাংশ), আট প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান ষষ্ঠ।
এর বাইরে হলবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যাংকার্স আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন ওয়েইস ইসলাম। পেয়েছেন ৬৩৬ ভোট (১.৬ শতাংশ), ১২ প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান সপ্তম।
নিউক্যাসেল সেন্ট্রাল ওয়েস্টে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হাবিব রহমান। তিনি পেয়েছেন ১৬৩৬ ভোট, সাত প্রার্থীর মধ্যে তার অবস্থান সবার তলানিতে।
বেক্সহিল ব্যাটল আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়াই করেন আবুল কালাম আজাদ। ২২০৬ ভোট পেয়ে ১০ প্রার্থীর মধ্যে তিনি ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেছেন।
এমটিআই