• ঢাকা
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
কিয়ার স্টারমার

‘ইন্ডি কিড’ থেকে প্রধানমন্ত্রী


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জুলাই ৬, ২০২৪, ১১:০১ এএম
‘ইন্ডি কিড’ থেকে প্রধানমন্ত্রী

ঢাকা : বছর তিনেক আগেও লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছিলেন কিয়ার স্টারমার।

২০২১ সালের সেই সময়টিতে ডুরহাম কাউন্টির হার্টপুল আসনের উপনির্বাচনে কনজারভেটিভ প্রার্থীর কাছে হেরে যায় লেবার প্রার্থী; ১৯৭৪ সালে ওই আসন গঠনের পর প্রথমবার সেখানে ভোটে হারে লেবাররা।

তবে এবারের সাধারণ নির্বাচনে ওই আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে লেবার পার্টি। সেখানে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন দলটির প্রার্থী জনাথান ব্রাশ।

বিবিসি লিখেছে, স্টারমারের ডাউনিং স্ট্রিটের যাত্রার পথ যে সোজা ছিল না, হার্টপুলে উপনির্বাচনের ফলাফলকে তার ‘রিমাইন্ডার’ বলা যেতে পারে। বস্তুত, তার জীবন ও ক্যারিয়ারের দীর্ঘ সময় গেছে খুবই ভিন্ন পথে।

একসময় দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ভাবনা এলেও কঠিন সময় পার করে কিয়ার স্টারমারই এখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, যিনি ব্রিটিশ ইতিহাসে পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে বিরোধী দলে থাকা লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছেন।

২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পর যুক্তরাজ্যের ‘পরিবর্তনের’ প্রচার চালিয়ে ২০২৪ সালের ভোটে বিপুল ব্যবধানে তিনি জয় পেয়েছেন।

৬২ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের জন্ম ১৯৬২ সালে, লন্ডনের সাউথওয়ার্কে। বেড়ে ওঠা কেন্ট-সারে সীমান্তের ওক্সটেডে। তার বাবা যন্ত্রপাতি তৈরি ও মেরামতের কাজ করতেন, মা পেশায় ছিলেন নার্স। ছোটবেলায় ‘স্টিল’স ডিজিজ’ নামের এক ধরনের আর্থ্রাইটিসে ভোগেন স্টারমার।

নির্বাচনি প্রচারের সময় ১৯৭০ এর দশকে যুক্তরাজ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কঠিন সময়ের জীবনযাপনের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে স্টারমার বলেছিলেন, আপনি যদি শ্রমজীবী শ্রেণির হন, তাহলে ঋণ নিয়ে আপনি ভয় পাবেন। আমার বাবা-মা সেরকমই ঋণ নিয়ে ভয়ে ছিলেন।

ফলে ঋণ শোধ করতে হবে না, এমন বিলই শ্রমজীবীরা পছন্দ করবেন।

ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্টারমার। ফুটবল খেলার পাশাপাশি তার সংগীত প্রতিভা ছিল। নরম্যান কুকের কাছে ভায়োলিন বাজানোও শিখেছিলেন।

দুরন্ত স্বভাবের স্টারমার একবার বন্ধুদের সঙ্গে ফ্রান্সের এক সৈকতে অবৈধভাবে আইসক্রিম বিক্রির সময় পুলিশের হাতে আটকও হয়েছিলেন।

এতসবের পরেও রাজনীতিতে তিনি আসলে কেমন?

বিবিসি লিখেছে, লেবার পার্টির প্রথম নেতা কিয়ার হার্ডির সঙ্গে কিয়ার স্টারমারের নামের একটা মিল রয়েছে। যুক্তরাজ্যের পার্লামান্টে আসার আগে তিনি বামপন্থি রাজনীতিতে জড়ান; রাজনৈতিক এই মতাদর্শের শুরুটা হয়েছিল স্কুল জীবনেই। সেসময় তিনি ‘ইয়ং সোশ্যালিস্ট’ ও লেবার যুব আন্দোলনে যোগ দেন।

স্কুল জীবন পার করার পর কিয়ার স্টারমারই তার পরিবারের প্রথম ব্যক্তি, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। লিডস ইউনিভারর্সিটিতে আইন বিষয়ে পড়েন। পড়ে অক্সফোর্ডেও পড়ালেখা করেন।

লিডসে পড়ার সময়ই আশির দশকে ‘ইন্ডি মিউজিকে’ আকৃষ্ট হন। ‘দ্য স্মিথস’ ও ‘দ্য ওয়েডিং প্রেজেন্ট’ থেকে শুরু করে ‘অরেঞ্জ জুস’ ও ‘অ্যাজটেক ক্যামেরা’ ব্যান্ড তার পছন্দের ছিল।

টম বাল্ডউইন তার জীবনীতে লিখেছেন, স্নাতক সম্পন্ন করার পরে স্টারমার উত্তর লন্ডনের একটি পতিতালয়ের উপরে থাকতেন। দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর কাজকর্মের মধ্যে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। একই সময়ে তিনি তার বামপন্থি কার্যক্রম চালিয়ে যান, যুক্ত হন ‘স্যোশালিস্ট লইয়্যার’ ম্যাগাজিনের সঙ্গে।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও শুরুর দিকে সেটি তার মূল লক্ষ্য ছিল না, ২০ বছরের মত আইনপেশাতেই মনোযোগী ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি পাবলিক প্রসিকিউশনের পরিচালক হন। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের প্রধান প্রসিকিউটর হন।

২০১০-১৫ সালের জোট সরকারের সময় ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের বাজেট এক চতুর্থাংশেরও বেশি কমানো হয়েছিল, যা স্টারমারকে বাস্তবায়ন করতে হয়। পার্লামেন্টের ব্যয় সংক্রান্ত এমপিদের মামলাসহ উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তগুলো তাকে নিতে হয়।

আইনপেশার লম্বা ক্যারিয়ারে তিনি ২০১৪ সালে নাইটহুড পান। পাবলিক প্রসিকিউশনের পরিচালক মেয়াদ শেষে বিবিসির এক প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যের বিচার ব্যবস্থায় এখনও দুর্বলরা হতাশ হচ্ছেন।

ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরে দেরিতে : ৫২ বছর বয়সে এসে আইনপেশার ক্যারিয়ার থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হন কিয়ার স্টারমার। ২০১৫ সালে লেবার পার্টির হয়ে উত্তর লন্ডনের এমপি হন তিনি। তার প্রতিদ্বন্দ্বী, সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকও একইসময়ে এমপি নির্বাচিত হন। তবে লেবার পার্টির জন্য সেটি ভালো সময় ছিল না।

ওই নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি জয় পায়। জেরেমি করবিনের নেতৃত্বের লেবার পার্টিতে তখন ছিল তিক্ত বিভাজন।

করবিন তার নেতৃত্বে স্যার কিয়ারকে ছায়া অভিবাসন মন্ত্রী করেছিলেন, তবে তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করেন। ব্রেক্সিট ইস্যুতে গণভোটের পর করবিনকে সরাতে দলটির সামনের সারির ডজনের বেশির নেতার সঙ্গে তিনিও পদত্যাগ করেন। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলে কিয়ার স্টারমার ছায়া ব্রেক্সিট মন্ত্রী হয়ে ফিরে আসেন।

লেবার শিবিরে অস্থিরতা : করবিনের বিষয়ে স্টারমারের অবস্থান সময়ের সঙ্গে বদলেছে।

২০১৯ সালে তিনি বিবিসি ব্রেকফাস্টকে বলেছিলেন, জেরেমি করবিন একজন মহান প্রধানমন্ত্রী হবেন।

কয়েক মাস পরে তিনি বলেন, করবিনের সঙ্গে তিনি শতভাগ রয়েছেন এবং সাধারণ নির্বাচনে জয় পেতে তার সঙ্গে কাজ করছেন।

দলের অন্যরা করবিনের নেতৃত্ব থেকে দূরে থাকলেও স্টারমার তার সঙ্গেই ছিলেন। পরে ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় ব্রেক্সিট ইস্যুতে দ্বিতীয় গণভোট সমর্থনে করবিনকে রাজি করাতে সাহায্য করেন। কিন্তু সেই নির্বাচন লেবারদের জন্য বিপর্যয় ছিল। পরে করবিন পদত্যাগ করেন এবং তার জায়গায় নেতৃত্বে আসেন স্টারমার।

লেবার পার্টির দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকেই ভেবেছিলেন স্টারমার দলকে পুনর্গঠনে সাহায্য করবেন। তবে কম লোকই ভেবেছিলেন, স্টারমার তার দলকে যুক্তরাজ্যের সরকার ক্ষমতায় ফেরাবেন।

পরিবর্তন যখন ঘটে : ২০২০ ও ২০২১ সালে জনমত জরিপে কনজারভেটিভ পার্টির বরিস জনসনকে পেছনে ফেলেন স্টারমার। ওই সময় লেবারদের দখলে থাকা হার্টপুলে উপনির্বাচন হয়।

কিন্তু পরিবর্তন আসে করে কোভিড মহামারীর সময়। জনসমাবেশ ও অনুষ্ঠান না করার কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে ডাউনিং স্ট্রিটে পার্টি করেন বরিস জনসন। যা নিয়ে পরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালে জনমত জরিপে কনজারভেটিভ পার্টিকে ছাড়িয়ে যায় লেবার পার্টি।

বরিস জনসনের পর লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হন। তার ৫০ দিনের মেয়াদের সময়ে লেবার পার্টির অবস্থান আরও পোক্ত হয় এবং এর ধারবাহিকতা চলতে থাকে।

একজন ‘নির্মম’ নেতা : লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পেছনে দলটির মিত্রদের অনেকের যুক্তি দিয়ে থাকেন, দলের ভেতরে বড় পরিবর্তন না আনেলে এই অবস্থান তৈরি হত না। স্যার কিয়ার এক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের বেলায় মাঝেমধ্যে ‘নির্মম বা কঠোর’ হয়েছেন।

তাদের ভাষ্য, জেরেমি করবিনকে সংসদীয় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত লেবার পার্টির হয়ে দাঁড়াতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। অর্থনৈতিক নীতি কঠোর করা হয়েছিল। অর্থাত্ নীতিগুলো মানুষের নাগালের মধ্যে না হলে সেগুলো বাতিল করা হয়েছিল।

এছাড়া ব্রিটিশ দেশপ্রেমকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। দেশপ্রেমের নমুনা দেখাতে বক্তব্য দেওয়ার সময় পেছনে যুক্তরাজ্যের পতাকা তিনি ব্যবহার করেন। ‘গড সেইভ দ্য কিং’ গাওয়ার জন্য সম্মেলন করেন। এসব কর্মকাণ্ডের সবকিছুই কিয়ার স্টারমারের ‘পরিবর্তনের’ প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরে।

ভোটের প্রচারের সময় তিনি বলেন, নিজ দলের পরিবর্তনের সঙ্গে তিনি যুক্তরাজ্যের পরিবর্তনও আনবেন। সবশেষ ভোটের ফলাফলেও সেই প্রতিশ্রুতির প্রভাব পড়েছে। দল হিসেবে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে লেবার পার্টি, ১৪ বছর পর ফিরেছে ক্ষমতায়।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!