ঢাকা: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে বহু শাসক ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাবার নজির রয়েছে। জনরোষ থেকে বাচার জন্যই তারা মূলত দেশ ছেড়ে যাবার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
এদের মধ্যে অনেকেই কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছাড়া বহু বছর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে বসেছিলেন। কেউ কেউ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পরে স্বৈরশাসকদের মতো আচরণ করেছে। কেউ কেউ আবার রাজনীতির মারপ্যাঁচে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।
লিবিয়ার গাদ্দাফি
লিবিয়ার ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী নেতা, যিনি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন, তার ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গাদ্দাফি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবেন।
যদিও লিবিয়ায় ২০২৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, কিন্তু সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না।
নির্বাচন যখনই অনুষ্ঠিত হোক না কেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার ময়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফি রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
২০১১ সালে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার পর তার ছেলে সাইফ আল গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাতে আটক হয়েছিলেন। তিনি প্রায় ছয় বছর বিদ্রোহীদের হাতে আটক ছিলেন। পরবর্তীকালে ২০১৭ সালে তিনি লিবিয়ার জিনতান প্রদেশ থেকে মুক্ত হন।
তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার বিচার চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
মিশরের হুসনি মুবারক
মিশরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হুসনি মুবারকের ছেলে গামাল মুবারকের পক্ষে অনলাইন প্রচারণা শুরু করেন অনেক মিশরীয়। এসব প্রচারণার মাধ্যমে তারা মিশরের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গামাল মুবারককে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান বলে জানান।
অনেকে মিশরীয় তাদের ফেসবুক এবং টুইটারে লেখেন, মিশরের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর জন্য গামাল মুবারক একমাত্র সমাধান। কিন্তু গামাল মুবারক শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি প্রায় ৮৯ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় রয়েছেন। যদিও সে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে প্রচুর।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, গামাল মুবারক ভবিষ্যতে মিশরের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। ২০১১ সালে হুসনি মুবারকের পতনের পর তার সাথে দুই ছেলেকেও গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২০১৭ সালে গামাল মুবারক কারাগার থেকে ছাড়া পান।
স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন মিশরের হুসনি মুবারক, যিনি ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন।
ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো
১৯৯৮ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো। তার ক্ষমতাচ্যুতির পরে দেশটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে।
সুহার্তো ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবার ১৬ বছর পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার মেয়ে সিতি হেদাইতি সুহার্তো, যিনি তিতেক সুহার্তো হিসেবে পরিচিত, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
সে নির্বাচনে তিনি বলেছেন, তার বাবা সুহার্তো ক্ষমতা ছাড়ার পরে দেশে তেমন কোন অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি বাবার ইমেজ তুলে ধরার চেষ্টা করছেন বারবার।
২০১৬ সালে সুহার্তোর ছেলে টমি সুহার্তো একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দলে সুহার্তোর মেয়ে থাকলেও পরবর্তীতে তিনি সেটি ত্যাগ করে গেরিন্দ্র পার্টির সাথে যুক্ত হন।
এই পার্টির নেতা হচ্ছেন তার সাবেক স্বামী। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে সুহার্তোর মেয়েকে দলটির উপদেষ্টা বানানো হয়েছিল। সে নির্বাচনে তার স্বামী প্রাবোউ সুবিনাতো জয়লাভ করেন।
সুহার্তো ক্ষমতায় থাকার সময় ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা সুবিনাতোর সাথে বিয়ে হয় তিতেক সুহার্তোর। ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের পর তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
সুহার্তো ক্ষমতায় থাকার সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল সুবিনাতোর বিরুদ্ধে। তখন তিনি স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন।
সুহার্তোর পতনের পর সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় মি. সুবিনাতোকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সুবিনাতোকে আমেরিকায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
ফিলিপিনসের মার্কোস
ফিলিপিন্স-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্ডিন্যান্ড ই মার্কোস ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত হাবার পর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানে করে গুয়াম দ্বীপে আশ্রয় নেন।
মার্কোস ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। স্বৈরাচার মার্কোস ক্ষমতাচ্যুত ও পালিয়ে যাবার ৩৬ বছর পরে ২০২২ সালে তার ছেলে ফার্ডিন্যান্ড মার্কোস জুনিয়র ফিলিপিন্স-এর প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।
নির্বাচনে জেতার পর তিনি বলেছিলেন, “পূর্বপুরুষকে দিয়ে আমার মূল্যায়ন করবেন না। আমার কাজ দিয়ে আমাকে মূল্যায়ন করুন।”
নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দেশের ভেতরে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনা। নির্বাচনে তিনি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছিলেন।
নির্বাচনের সময় তিনি অনলাইন প্রচারণার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন তার বাবার শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং স্থিতিশীলতা এসেছিল।
থাইল্যান্ডের থাকসিন
২০০৬ সালে থাইল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াতকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল দেশটির সেনাবাহিনী। দেশটিকে ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে থাকসিন শিনাওয়াতের দল বিপুল জয় পেয়েছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে একটি টেলিকম কোম্পানি বিক্রয়কে কেন্দ্র করে থাকসিন শিনাওয়াতের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়।
তখন তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর থাকসিন শিনাওয়াত ও তার রাজনৈতিক দলকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।
নির্বাচনে প্রতারণার অভিযোগে থাকসিন শিনাওয়াতের দলের আরো ১১১ জন নেতাকে পাঁচ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর মি. থাকসিন ব্রিটেনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান।
থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ধনকুবের থাকসিন শিনাওয়াতের মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছে দেশটির পার্লামেন্ট।
৩৭ বছর বয়সী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা হবেন দেশটির সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। এর আগে তার ফুফু ইংলাক সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তার বাবা থাকসিন শিনাওয়াত ও ফুপু ইংলাক সিনাওয়াত্রাসহ অপর তিনজন সামরিক অভ্যুত্থান বা সাংবিধানিক আদালতের রায়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন।
এর আগে ২০১১ সালে থাকিসন সমর্থিত একটি রাজনৈতিক দল ফিউ থাই পার্টি নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং তার বোন ইংলাক শিনাওয়াত প্রধানমন্ত্রী হন।
পাকিস্তানের নওয়াজ শরীফ
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের রাজনৈতিক জীবন বেশ উত্থান-পতনের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছে। মি. শরীফ তিনবার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন এবং বারবারই ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন।
কারগিল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সেনা প্রধানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন নওয়াজ শরীফ। এরপর সেনাপ্রধান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর তাকে বিচারের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং সৌদি বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুলাজিজের মধ্যস্থতায় নওয়াজ শরীফ ছাড়া পেয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে সৌদি আরব চলে যান ২০০২ সালে।
২০০৭ সালেও তিনি ফিরে এসেছিলেন, যখন তিনি ও তার প্রতিপক্ষ বেনজীর ভুট্টো সেনাবাহিনীর সাথে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে আসেন।
১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানোর পর আবারও তাকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়। এরপর ২০১৩ সালের নির্বাচনে আবারো ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরীফ।
কিন্তু ২০১৭ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণার পর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
শরিফ তিন বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, এবং তিন বারই তিনি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমতা হারিয়েছেন - প্রথমবার রাষ্ট্রপতির সাথে দ্বন্দ্বের জের ধরে পদত্যাগ করেছেন, দ্বিতীয়বার সেনাবাহিনী তাঁকে হটিয়েছে, এবং ২০১৭ সালে আদালতের মাধ্যমে।
২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) এর নির্বাচনি স্লোগান ছিল ‘পাকিস্তান কো নওয়াজ দো’, অর্থাৎ ‘পাকিস্তানকে নওয়াজ দাও’।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন নওয়াজ শরিফের ভাই শেহবাজ শরিফ। এরপর ২০২৪ সালের নির্বাচনে নওয়াজ শরীফের দল ৭৫ আসনে জয়লাভ করে। পরে রাজনৈতিক শরীকদের নিয়ে সরকার গঠন করা হলে তার ভাই শেহবাজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী হন।
আইএ