ঢাকা : মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বড় ধরনের সামরিক সাফল্য পেয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জোট জান্তাকে হটিয়ে দিয়ে পূর্ব মিয়ানমারের এক বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছে।
‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ নামে ওই জোট আসলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী তিনটি শক্তিশালী বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ে গঠিত। তাদের যোদ্ধারা এখন মিয়ানমারের দ্বিতীয় শহর মান্দালয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স, যা ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ নামেও পরিচিত, মিয়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী তিনটি সশস্ত্র সংগঠন নিয়ে গঠিত। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সর্বশেষ বাহিনী হিসেবে উঠে এসেছে এই জোট।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সে কারা আছে?
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সে আছে মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি। তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি দেশটির পূর্ব দিকে আর আরকান আর্মি পশ্চিমাঞ্চলের বাহিনী।
অতীতে তারা নিজেদের অঞ্চলগুলোর জন্য আরও স্বাধীনতা আনতে মিয়ানমারের সরকারী বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছে। এখন তারা বলছে যে সামরিক সরকারকে উৎখাত করাই তাদের লক্ষ্য।
অং সান সু চির বেসামরিক নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসে সামরিক সরকার। মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, এমএনডিএএ, মূলত মিয়ানমারের চীন সীমান্ত লাগোয়া শান প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী কোকাং জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত। কোকাং জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা ম্যান্ডারিন ভাষায় কথা বলেন এবং নিজেদের তারা হান-চীনা হিসাবে চিহ্নিত করে।
এমএনডিএএ ১৯৮৯ সালে গঠিত হয়। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধী এবং চীন সমর্থিত গেরিলা বাহিনী বার্মা কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গঠিত হয়েছিল এমএনডিএএ।
এমএনডিএএ প্রায়শই সরকারী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে কোকাংদের বসবাসের অঞ্চলটির জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে থাকে।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলছে, মাদক ব্যবসার মাধ্যমে তারা নিজেরাই অর্থের সংস্থান করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এটিকে ‘মাদক বিদ্রোহ’ নামে অভিহিত করে থাকে।
তাং বা পালাউং নামে পরিচিত জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনী তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি বা টিএনএলএ ওই একই উত্তরাঞ্চলীয় শান প্রদেশের বাহিনী। তারা তাং অঞ্চলের জন্য আরও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ২০০৯ সাল থেকে সরকারী বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের তৃতীয় বাহিনী আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন প্রদেশের আরাকান জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে তৈরি। অন্য দুটি বাহিনীর মতোই আরাকান আর্মিও তাদের নিজেদের অঞ্চলের আরও বেশী স্বাধীনতার জন্য ২০০৯ সাল থেকে লড়াই করছে।
ফ্রাঙ্কফুর্টের থিংক ট্যাঙ্ক পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইয়লং শিয়ান বলছেন, এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর গঠনতন্ত্র নিয়মিত সেনাবাহিনীর মতোই। তারা বিদ্রোহী বাহিনী বা মিলিশিয়ার থেকে বেশি সংগঠিত।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স যেভাবে লড়ছেগত বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অধীন তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমারের সরকারি সেনাবাহিনীর (যেটি তাতমাদাও নামে পরিচিত) বিরুদ্ধে শান প্রদেশ জুড়ে সমন্বিত আক্রমণ চালায়। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ১০২৭’।
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) তথ্য অনুযায়ী, জোটের অধীন প্রায় ১০ হাজার যোদ্ধা এতে অংশ নিয়েছিল।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স বাহিনী সরকারি সেনা চৌকি দখল করে নেয় এবং বেশ কয়েকটি শহর দখল করে। এমএনডিএএ চীন সীমান্তের একটি প্রধান শহর লাউক্কাই পুনরায় দখল করে। এই শহরটি থেকে এমএনডিএএ যোদ্ধাদের ২০১৫ সালে তাড়িয়ে দিয়েছিল সরকারি সামরিক বাহিনী।
আগস্টের শেষের দিকে, এমএনডিএএ উত্তরাঞ্চলীয় শান প্রদেশের লাশিও-র দিকে এগোতে থাকে এবং এক সময়ে শহরটি দখল করে নেয়। লাশিওতে তাতমাদাও-র উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তরও দখল করে নিয়েছে তারা। বিদ্রোহীদের হাতে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সেনা-কেন্দ্রের পতনের ঘটনা মিয়ানমারের ইতিহাসে আগে কখনও হয় নি।
একই সময়ে, টিএনএলএ শান প্রদেশ থেকে মধ্য মিয়ানমারে অগ্রসর হয়। সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা এখন মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের দোরগোড়ায় অবস্থান করছে। ওই শহরটির জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ।
শহরের পূর্বদিকে টিএনএলএর বাহিনী রয়েছে আর মান্দালয় পিপলস ডিফেন্স ফোর্স নামে একটি স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যার মান্দালয়ের উত্তরে পাহাড়ে অবস্থান করছে।
জান্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে?
আইআইএসএস-এর মরগান মাইকেলস বলেন, এটি সামরিক সরকারের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুতর হুমকি। মান্দালয় দেশের মাঝামাঝি এলাকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর।
তিনি বলছেন, এই সরকারকে পরাজিত করার জন্য ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স একটি নতুন পথ খুলে দিয়েছে। তারা শান প্রদেশ থেকে মান্দালয় পর্যন্ত এগিয়েছে, সম্ভবত সেখান থেকে রাজধানী নেপিদোর দিকে এগোবে তারা।
‘কন্ট্রোল রিস্কস’ নামে যে সংস্থাটি বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে পররাষ্ট্র বিষয়ে পরামর্শ দেয়, তারা বলছে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী এখন দেশটির অর্ধেকেরও কম অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।
তবে কন্ট্রোল রিস্কস-এর স্টিভ উইলফোর্ড বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সরকারি বাহিনীর হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা এখন মান্দালয়কে রক্ষার করার জন্য সব অর্থ, লোকবল, অস্ত্র – সব কিছু ঢেলে দিচ্ছে। যেটা হওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি, তা হল আরও কয়েক মাস যুদ্ধ চলবে, ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে।
অর্গানাইজেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিসের মতে, ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অপারেশন ১০২৭ চলাকালীন প্রায় তিন লক্ষ ৩০ হাজার বেসামরিক নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে এমএনডিএএ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে, সম্ভবত চীনের চাপে পড়ে। সেখানে বলা হয় যে তারা মান্দালয় বা শান প্রদেশের রাজধানী তৌঙ্গি আক্রমণ করবে না। এটাও বলে, যে তারা যুদ্ধবিরতিতে রাজি এবং সামরিক সরকারের সঙ্গে শান্তি স্থাপনে চীনের মধ্যস্থতা মেনে নেবে।
তবে বিবৃতিটি এমএনডিএএ-র, অন্য জোটসঙ্গী এএ, টিএনএলএ এবং মান্দালয় পিডিএফের মতামত এই বিবৃতিতে প্রতিফলিত হয় নি।
ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স কী চায়?
সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে মিয়ানমারের ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি)। এটি ২০২১ সালে জান্তা কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের একটি গোষ্ঠী। থাইল্যান্ডে নির্বাসিত থাকা অবস্থায় তারা নিজেদের মিয়ানমারের বৈধ সরকার বলে মনে করে।
এই গোষ্ঠীটির লক্ষ্য হল মিয়ানমারে একটি বেসামরিক, গণতান্ত্রিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। পিপলস্ ডিফেন্স ফোর্স নামে তাদেরও নিজস্ব সশস্ত্র গোষ্ঠী আছে যারা সরকারি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে।
ফ্রাঙ্কফুর্টের থিংক ট্যাঙ্ক পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইয়লং শিয়ান বলেন, ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স বলেছে যে তারা সামরিক জান্তাকে উৎখাত করার এনইউজির লক্ষ্যের সঙ্গে সহমত, তবে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করার জন্য কোনো চুক্তি উভয় পক্ষ করেনি।
তিনি বলেন, ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অন্তর্ভুক্ত গোষ্ঠীগুলো যা চায় তা হলো তাদের নিজেদের অঞ্চলের জন্য আরও স্বায়ত্তশাসন।
তার কথায়, মধ্য মিয়ানমারের দিকে তাদের অগ্রসর হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারকে আরও চাপ দেওয়া।
শিয়ান বলেন, এনইউজির প্রতি তাদের সমর্থন কেবল মুখের কথা। দুই পক্ষ যে এক হয়ে কোনও সামরিক অভিযান চালাবে, এমন পরিকল্পনা তো দেখা যাচ্ছে না।
চীন কীভাবে জড়িত?
শিয়ানের কথায়, চীনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমারের সংঘাত যেন তাদের সীমান্ত থেকে দূরে থাকে। অনেক চীনা নাগরিক এমএনডিএএ-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের অর্থও দেয়।
তিনি আরও বলেন, চীন সরকার প্রাথমিকভাবে অপারেশন ১০২৭ সমর্থন করেছে বলে মনে হচ্ছে। এর কারণ হল যে তারা চেয়েছিল এমএনডিএএ বাহিনী কোকাং অঞ্চল থেকে আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে তাড়িয়ে দিক। সেই গোষ্ঠীটি সাইবার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে চীনা নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল।
তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলীয় শান প্রদেশে এর আগের সংঘর্ষগুলোতে চীন যুদ্ধবিরতির জন্য অনেক আগেই হস্তক্ষেপ করেছিল। তবে এবার তার ততক্ষণ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেনি যতক্ষণ না এমএনডিএএ কোকাংয়ের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে।
তবে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের মধ্য মিয়ানমারের দিকে এগিয়ে যাওয়া চীনকে কিছুটা বিস্মিত করেছে বলে মনে হচ্ছে। তারা পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হারিয়েছে।
ইয়লং শিয়ান বলছেন, চীন সরকার এমএনডিএএকে চাপ দিয়ে চৌঠা সেপ্টেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে একটি বিবৃতি দেওয়াতে রাজি করায়। তবে চীনকে খুশি করতে এর আগেও তারা এ ধরনের বিবৃতি দিয়েছে।
তিনি বলছেন, নিশ্চিতভাবেই তিনটি গোষ্ঠীই লড়াই চালিয়ে যাবে- বিশেষ করে আরাকান আর্মি এবং টিএনএলএ - কারণ নিজেদের এলাকার ওপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ এখনও স্থিতিশীল নয়।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :