ঢাকা: লেবাননে ইসরায়েলের বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হয়েছেন। তিনি ৩২ বছর এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। দীর্ঘদিনের এই নেতাকে হারিয়ে এখন বেশ চাপে ইরানপন্থী শক্তিশালী গোষ্ঠীটি।
নাসরাল্লাহকে হত্যা করতে গত সপ্তাহের শুরুর দিকে অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা। সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নাসরাল্লাহকে হত্যার জন্য কয়েক মাস ধরে অনুসরণ করছিল ইসরায়েল। তার অবস্থান সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন দেশটির নেতারা।
ইসরায়েলের তিনজন জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, নাসরাল্লাহকে হত্যা করতে শুক্রবার রাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে ৮০টির বেশি বোমা ফেলা হয়।
ওই তিন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন নাসরাল্লাহর চাচাতো ভাই হাশেম সাফিয়েদ্দিন। শুক্রবারের হামলার সময় তিনি নাসরাল্লাহর সঙ্গে ছিলেন না। তাকে নাসরাল্লাহর উত্তরসূরি বলে মনে করা হয়।
কয়েক মাস ধরে নাসরাল্লাহর গতিবিধি অনুসরণ করছিলেন ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। অনেক বছর ধরে তিনি সরাসরি জনসমক্ষে আসতেন না। ৬৪ বছর বয়সী এই নেতা বিভিন্ন সময়ে টিভিতে দেওয়া ভাষণে অনুসারীদের বার্তা দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হুমকি উল্লেখ করে তিনি ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিতেন।
এদিকে নাসরাল্লাহর মৃত্যুর পর কোন অস্ত্রের ব্যবহারে তার মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়ে আগ্রহ পুরো বিশ্বের। টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ হত্যায় ইসরায়েল এফ-১৫আই ফাইটার জেট বিমান ব্যবহার করেছে। ইসরায়েলের বিমান ঘাঁটি ৬৯তম স্কয়ারড্রোন থেকে ওই বিমান উড্ডয়নের ছবি প্রকাশ করেছে আইডিএফ। শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ওই বিমান থেকেই হিজবুল্লাহর সদরদপ্তরকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালানো হয়।
ইসরায়েল সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বৈরুতের উপশহর দাহিয়ে মাটির নিচে অবস্থিত হিজবুল্লাহর সদরদপ্তরে হামলায় একাধিক ‘বাঙ্কার বাস্টার বোমা’ ব্যবহার করা হয়েছে।
‘গ্রাউন্ড পেনিট্রেশন মিইনিশন’ নামে পরিচিত এই ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরণের আগে মাটির গভীরে ঢুকে যায়। এ ক্ষেপণাস্ত্রের ভূগর্ভস্থ স্থাপনা এবং কঠিন কংক্রিট ভবন ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে।
‘বাঙ্কার-বাস্টার’ মাটির ৩০ মিটার গভীর বা ছয় মিটার কংক্রিট ভেদ করতে সক্ষম এবং শকওয়েভ তৈরির মাধ্যমে আশপাশের অন্যান্য কাঠামোও ধ্বংস করে দিতে পারে। এর প্রতিটির ওজন ২০০০ থেকে ৪০০০ পাউন্ডের মধ্যে।
যদিও জেনেভা কনভেনশন জনবহুল এবং নির্বিচারে হতাহতের ঝুঁকির কারণে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই বোমার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
এদিকে বৈরুতে বিমান হামলায় ইসরায়েল কী ধরনের বোমা ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে জানতে আল জাজিরার পক্ষ থেকে সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এলিজাহ ম্যাগনিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হয়। ইসরায়েলি এই বিশ্লেষক বলেন, আমাদের কাছে দুই ধরনের বোমা ব্যবহারের সুযোগ ছিল, অথবা এই দুটি ধরনের বোমা একইসাথে ব্যবহার করা যেত।
"সেক্ষেত্রে আমেরিকার তৈরি ও ইসরায়েলের অস্ত্রভাণ্ডারে থাকা জিবিইউ-৩১ জেড্যাম (জয়েন্ট ডাইরেক্ট এট্যাক মিউনিশন) ব্যবহার করা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের হাজার হাজার বোমা সরবরাহ করেছে, ইতোমধ্যেই গাজার অসংখ্য লক্ষ্যবস্তুতে এসব বোমা ফোলা হয়েছে। অন্য বোমাটি হচ্ছে, ইসরায়েলের অস্ত্র উৎপাদক রাফায়েলের তৈরি স্পাইস-২০০০।"
এলিজাহ বলেন, আমার মনে হয় এই দুই ধরনের বোমা ব্যবহার করা হয়েছে। আর তার ফলেই হামলার পর যে ধরনের ধ্বংস আমরা দেখেছি সেটা হতে পারে– যেখানে বিস্ফোরণের শক্তিতে একটি বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, যার মধ্যে ধসে পড়েছে আশেপাশের ভবন। আর ঠিক এজন্যই এমন ধ্বংসস্তূপ থেকে সব মরদেহ খুঁজে বের করা বা উদ্ধার করতে অনেক অনেক সময় লাগবে।
তিনি আরও জানান, 'এই হামলায় ৮৫ টন বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে বলে আমাদের জানায় ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। সেটাই ছিল এসম্পর্কে আমাদের প্রথম পাওয়া তথ্য। প্রতিটি বোমার ওজন ছিল এক টন করে। তাই এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য।'
'এসব বোমার আঘাতে বৈরুতে এক ধরনের ভূকম্পন তৈরি হয়। আমি সেখানকার অনেক অধিবাসীর সাথে কথা বলেছি, (ভূকম্পনের কারণে) যাদের সবার মনে হয়েছে যেন পাশের বাড়িতেই হামলাটি করা হয়েছে। বৈরুতের মতো একটি ঘনবসতির শহরের জন্য তা সত্যিই ভয়াবহ।'
প্রসঙ্গত, ইসরায়েল পুরোদমে হামলা শুরুর সপ্তাহ খানেক আগে লেবাননে পেজার এবং ওয়াকিটকিসহ নানা ধরনের তারহীন ডিভাইসে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দুটি আলাদা ঘটনায় হাজার হাজার পেজার এবং রেডিও ডিভাইস বিস্ফোরিত হওয়ায় কমপক্ষে ৩৭ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।
এসএস