ঢাকা : প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস, না রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প? কে যাবেন হোয়াইট হাউজে, সেদিকেই নজর পুরো বিশ্বের। দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় থাকা সেই নির্বাচনে মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) চূড়ান্ত রায় দেবেন মার্কিনিরা।
যদিও গত অক্টোবর থেকেই শুরু হয়েছে আগাম ভোটদান। গত রবিবার পর্যন্ত সাড়ে ৭ কোটি ভোট পড়েছে। বাংলাদেশ সময় আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ আমেরিকায় ভোট গ্রহণ শুরু হবে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় একে অপরকে পিছনে ফেলছেন ৬০ বছর বয়সী কমলা ও ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প। তবে তাদের দুই জনেরই ভাগ্য নির্ধারণ হবে সাতটি অনিশ্চিত বা দোদুল্যমান রাজ্যের ফলাফলের ভিত্তিতে। পাশাপাশি আজ ভোট গ্রহণ হবে মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের ৩৪ আসনে এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সব কটিতে।
উত্তেজনাপূর্ণ এই নির্বাচনে জায়গা করে নিয়েছে বাংলা ভাষাও। এদিকে এবারের নির্বাচন নানা দিক থেকেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ইউক্রেন থেকে গাজা ও লেবাননের যুদ্ধ পরিস্থিতি, চীন, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বিশ্বের সামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণসহ একাধিক বিষয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ভর করবে এই নির্বাচনের ফলাফলে। দেশটিতে ২৪ কোটি ৪০ লাখ নাগরিক ভোটদানের যোগ্য, নিবন্ধিত ভোটার ১৬ কোটির মতো। ইলেকটোরাল কলেজের মোট ভোটার সংখ্যা ৫৩৮। মেইন এবং নেব্রাস্কা এই দুটি রাজ্য বাদে বাকি সবগুলোর ইলেকটোরাল ভোট যোগ করলে যে প্রার্থী ২৭০টি পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সেই প্রার্থীর রানিংমেট হয়ে যাবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। কমলার রানিংমেট টিম ওয়ালজ এবং ট্রাম্পের রানিংমেট জেডি ভ্যান্স।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অনেক বিষয় কাজ করে। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বর্ণবাদী। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সাদা-কালোয় কোনো ভেদাভেদ নেই। কিন্তু বাস্তবে বছরের পর বছর এ বর্ণবাদী প্রথা ভোটের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট ভোটারের প্রায় ৭৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ। শ্বেতাঙ্গরা রিপাবলিকান তথা ট্রাম্পের সমর্থক। কারণ, তাদের বেশিরভাগ ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’তে বিশ্বাসী।
বলা হয়ে থাকে, শ্বেতাঙ্গরা সবাই ভোট দিতে গেলে রিপাবলিকান প্রার্থী কখনো হারবেন না। বাস্তবে সব শ্বেতাঙ্গ ভোট দিতে যান না। এদিক বিবেচনায় নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা বেশি। তবে কমলা হ্যারিসের মূল ভোট ব্যাংক নারী ভোটার। নারীরা মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। কমলা হ্যারিস নারীদের গর্ভপাত বৈধ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এতে নারীরা উচ্ছ্বসিত। নারী ভোটারের উপস্থিতি বেশি হলে নাটকীয়ভাবে কমলা হ্যারিস জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ভোটদানের পদ্ধতি : যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যেই ভোটের নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তা পরস্পরের থেকে আলাদা। মোটের ওপর ভোটাররা তিনটি প্রাথমিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। প্রথমত, হ্যান্ডমার্ক করা কাগজের ব্যালট : সবচেয়ে প্রচলিত এবং সহজ পদ্ধতিতে প্রায় ৭০ শতাংশ কাগজের ব্যালট ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ হয়। দ্বিতীয়ত, ব্যালট মার্কিং ডিভাইস (বিএমডি) ২৫ শতাংশেরও বেশি ভোটার ব্যবহার করেন এই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ভোটদান পদ্ধতি। ভোটারদের একটি স্ক্রিনে বিকল্প নির্বাচন করতে দেয় এবং তারপর তাদের পছন্দ নিশ্চিত করতে একটি কাগজের ব্যালট প্রিন্ট করা হয় এই ব্যবস্থায়। ‘হেল্প আমেরিকা ভোট অ্যাক্ট’ মেনে চালু করা এই পদ্ধতিতে বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ পদ্ধতিও রয়েছে। তৃতীয়ত, ডাইরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক (ডিআরই) এই পদ্ধতি অনেকটা ইভিএমের মতো। কাগজ ছাড়া ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায় জনতার রায় দেওয়া হয়। লুইজিয়ানা এবং নেভাদায় চালু হওয়া পদ্ধতিতে মোটের ওপর ৫ শতাংশ ভোটার আস্থাশীল।
ভোট গণনা হয় যেভাবে : কাগজের ব্যালট এবং বিএমডিতে দেওয়া ভোটগুলো সাধারণত ‘অপটিক্যাল স্ক্যানার’ ব্যবহার করে স্ক্যান করা হয়। এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফলাফল নথিভুক্ত করা যায়। এই প্রক্রিয়াটি একটি প্রাদেশিক স্তরের নির্বাচন কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করেন। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণনার পাশাপাশি প্রয়োজনে হাতে ভোট গণনারও ব্যবস্থা আছে। এছাড়া আগাম ভোটের ক্ষেত্রে চালু ‘মেইল ইন ব্যালট’ ব্যবস্থায় দেওয়া ভোটের বৈধতা যাচাই এবং গণনার প্রক্রিয়াও রয়েছে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে। অঙ্গরাজ্যের নির্বাচন কর্তৃপক্ষকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে ফলাফল ফেডারেল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করতে হয়।
জনপ্রিয়তার লড়াইয়ে কে এগিয়ে : ২০২০ সালে জো বাইডেন ক্ষমতায় বসার সময় চলছিল করোনা মহামারি। তখন মহামারি পরিস্থিতি শক্ত হাতে সামলেছিল বাইডেন প্রশাসন। তবে এ করোনাই পরে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন অর্থনীতিতে চাপ আসায় বেড়ে যায় দ্রব্যমূল্য, দেখা দেয় কর্মসংস্থানের অভাব। অভিবাসীদের নিয়েও শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারেননি বাইডেন। এসবের জেরে তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে।
মূলত এসব কারণেই বাইডেন ক্ষমতায় আসার কিছু সময় পর থেকে ডেমোক্র্যাটদের দীর্ঘদিনের আধিপত্য কমতে থাকে। এবারের নির্বাচনী প্রচারে নামার পর ট্রাম্পকে দুবার হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। এটিও তার জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়াতে সহায়তা করেছে। তবে গত রবিবার সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নানা ফৌজদারি মামলা ঘাড়ে নিয়ে চলা ট্রাম্প নির্বাচনে জিতলেও সে কৃতিত্ব তার নিজের হবে না। বাইডেন প্রশাসনের প্রতি মানুষের অসন্তোষই তার জয়ের পেছনে কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ৪৩টিতে কমলা নাকি ট্রাম্প—কে জিতবেন, তা অনেকটা নিশ্চিত। সমস্যা দোদুল্যমান সাত অঙ্গরাজ্য—পেনসিলভানিয়া, অ্যারিজোনা, নেভাদা, উইসকনসিন, নর্থ ক্যারোলাইনা, মিশিগান ও জর্জিয়াকে নিয়ে। এই সাত অঙ্গরাজ্যের ফল কমলা–ট্রাম্পের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে।
গতকাল নিউইয়র্ক টাইমসের জনমত জরিপে দেখা গেছে, দেশজুড়ে ৪৯ শতাংশ মানুষ কমলা ও ৪৮ শতাংশ ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এ ছাড়া দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্প ১ শতাংশ, অ্যারিজোনায় ৪ শতাংশ, নেভাদায় ১ শতাংশ, নর্থ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়ায় ১ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। কমলা উইসকনসিনে ১ শতাংশ ও মিশিগানে ১ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।
কবে জানা যাবে ফল : সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে স্থানীয় সময় ৫ নভেম্বর রাত বা ৬ নভেম্বর দিনের মধ্যে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। তবে ঝামেলা হলে চূড়ান্ত ফল জানতে কয়েক দিন লাগতে পারে। যেমন ২০২০ সালের নির্বাচনে চার দিন পর চূড়ান্ত ফল জানা গিয়েছিল। সে বছর কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়েছিল। আবার ২০১৬ সালে ৫ নভেম্বর রাতের মধ্যেই ফল জানা গিয়েছিল।
ভোটাররা মূলত ইলেকটোরাল কলেজ নির্বাচিত করবেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বর তাদের ভোটে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। যুক্তরাষ্ট্রে মোট ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে একজন প্রার্থীকে ২৭০টি ভোট পেতে হয়। এই ভোট আবার ২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে গণনা করা হবে। সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হবেন নতুন প্রেসিডেন্ট। এরপর ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়ে পাকাপাকিভাবে হোয়াইট হাউসে বসবেন তিনি।
এমটিআই