ঢাকা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। ১৭৯৮ সালের মার্কিন মসনদে বসেন তিনি। তবে এরপর থেকে অনেক প্রেসিডেন্ট এসেছেন দেশটিতে, কিন্তু ২৩৫ বছরের ইতিহাসে কোনো নারী প্রেসিডেন্ট পায়নি যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৬ সালের নির্বাচনে বিচক্ষণ রাজনীতিক ডেমোক্রেটিক হিলারি ক্লিনটন হেরেছিলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। এবারও সেই ট্রাম্পকেই টেক্কা দিচ্ছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। সবার মনে একটাই প্রশ্ন কমলা কি পারবেন ২৩৫ বছরের ইতিহাস ভাঙতে? তিনি কি পারবেন রেকর্ড গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে?
অভিবাসী পরিবার থেকে উঠে আসা কমলার সামনে এখন ইতিহাস গড়ার হাতছানি। নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ২৩৫ বছরের ইতিহাসে কমলাই হবেন প্রথম কোনো নারী প্রেসিডেন্ট।
কমলা হ্যারিস এবার নাটকীয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছেণ। ডেমোক্র্যাট দলের পূর্ব ঘোষিত প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বয়স ও শারীরিক যোগ্যতা বিবেচনায় নির্বাচন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করায় কোন প্রকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছেন তিনি।
পরবর্তীতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চূড়ান্ত মনোনয়ন পান কমলা। যা যুক্তরাষ্ট্রে নজিরবিহীন। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এরই মধ্যে হোয়াইট হাউজ তার বেশ পরিচিত। তবে এবারের জন রায়ে বিজয়ী হলে চেয়ার বদল হয়ে বসবেন প্রেসিডেন্টের আসনে।
কমলার জন্ম ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার : ১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড শহরে কমলার জন্ম। মা শ্যামলা গোপালন হ্যারিস ছিলেন পেশায় ক্যানসার গবেষক ও নাগরিক অধিকারকর্মী। জ্যামাইকান-আমেরিকান বাবা ডোনাল্ড জ্যাসপার হ্যারিস ছিলেন অর্থনীতিবিদ।
শৈশবে তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হলে ফ্রান্সিসকোতে মায়ের কাছে বড় হন কমলা। পরবর্তীতে মায়ের কাছেই মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই আর সংস্কৃতির চর্চা শুরু তার।
ওয়াশিংটন ডিসির হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে তিনি পড়াশোনা শুরু করে শেষ করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০১৪ সালে আইনজীবী ডগ এমহফের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন কমলা। এরপর প্রথমে এটর্নি পরে ২০১৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় অঙ্গরাজ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রোট দলীয় সিনেটের নির্বাচিত হন।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে একসঙ্গে দুটি ইতিহাস গড়েন কমলা। এবার আরেক ইতিহাস তৈরি করতে পারবেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ১৭৮৯ সাল থেকে ব্যতিক্রমী কোন ঘটনা ছাড়া চার বছর অন্তর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে। তবে কোনো নারী এখন পর্যন্ত এই শীর্ষ পদে আসীন হতে পারেননি।
যদিও এবার শুরু থেকেই প্রচার প্রচারণা ও জনমত জরিপে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন কমলা হ্যারিস। তবুও বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখনও নারীর নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার অবস্থায় আসেনি আমেরিকার জনগণ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রিপাবলিনা মার্গারেট চেস স্মিথ প্রথম প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন। তিন দফায় যুক্তরাষ্ট্রের মেইন অঙ্গরাজ্যের সিনেটরের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতার প্রায় দুইশো বছর, ১৯৬৪ সালে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পার্থী ছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে একজন নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়টি অনিবার্য। ১৯৭৭ সালে করা এক মার্কিন জরিপ অনুযায়ী, দেশটির ৫০ শতাংশ জনগণ মনে করেন নারীরা আবেগি সিদ্ধান্ত নেয় দেখে তাদের রাষ্ট্রপরিচালনায় না আসাই ভালো। এর পর মার্কিন রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে মার্কিনি নারীদের লড়াই চলতে থাকে।
এবারও তুলনামূলক বেশিসংখ্যক নারী ভোটার কমলাকে সমর্থন করছেন; বেশিসংখ্যক পুরুষ ভোটার ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মার্কিনিরা মনে করেন, শক্তিশালী পুরুষ নেতৃত্ব দেশের মানুষকে শারীরিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে।
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নারী প্রার্থী হন হিলারি ক্লিনটন। সাবেক ফার্স্ট লেডি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেওয়ায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন তিনি। কিন্তু ৩০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েও ইলেক্টোরাল কলেজের নিয়মে পরাজিত হন ট্রাম্পের কাছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সব যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কেবল নারী হওয়ায় বিদ্বেষের শিকার হন হিলারি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আমেরিকায় পুরুষদের তুলনায় নারীদের ক্ষমতা এবং দক্ষতা সম্পর্কে জনসাধারণ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও গণমাধ্যমের কাছ থেকে নেতিবাচক ধারণার মুখোমুখি হতে হয়। লিঙ্গবৈষম্য, রাজনীতিতে সীমিত অংশগ্রহণ এবং তাদের যোগ্যতার অবমূল্যায়নের কারণে পুরুষদের তুলনায় নারীদের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
তবে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে নারী নেতৃত্বকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। তার প্রমাণ, এরই মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড করেছেন কমলা।
৫৯ বছর বয়সী কমলা হ্যারিস জয়ী হলেই তিনি দেশটির ২৩৫ বছরের গণতান্ত্রিক চর্চার ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নতুন কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারেন। যা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের উজ্জ্বলতম উদাহরণ।
এমটিআই