• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কমলা হ্যারিস কেন নারীদের ভোটও হারালেন


আন্তর্জাতিক ডেস্ক নভেম্বর ৮, ২০২৪, ০২:৩৫ পিএম
কমলা হ্যারিস কেন নারীদের ভোটও হারালেন

ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমলা হ্যারিসকে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত করায় এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, নারীদের অধিকার, বিশেষ করে গর্ভপাতের অধিকার ছিল দেশটির নারী ভোটারদের কাছে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু।

যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে ১৯৭৩ সালে আদালতের দেওয়া ‘রো বনাম ওয়েড’ রায় সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দেওয়ার পর গত মঙ্গলবারের ভোটই ছিল দেশটিতে প্রথম প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচন। ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্টের ওই আদেশের ফলে মার্কিন নারীরা গর্ভপাতের অধিকার হারান। এ আদেশের জন্য বারবার নিজের কৃতিত্ব দাবি করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সর্বোচ্চ আদালতে পছন্দের তিন রক্ষণশীল বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ায় এমন রায় পাওয়া সম্ভব হয়েছিল তার।

ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা এবারের নির্বাচনে নারী ভোটারদের কাছে টানতে প্রচারাভিযানে তাদের গর্ভধারণের অধিকার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্পের অবস্থানকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন, বিশেষ করে সুইং স্টেটস বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোয়।

প্রচারে কমলা গর্ভপাত নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য-বিবৃতিকে অনেক বড় করে টানেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কমলার নির্বাচনী প্রচার-সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনগুলোর একটির শিরোনাম ছিল, ‘পানিশমেন্ট (সাজা)’। এর মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের নির্বাচন-পূর্ব ট্রাম্পের একটি বিবৃতিকে বোঝান তিনি। ওই সময় ট্রাম্প যেসব নারী গর্ভপাত করবেন, তাঁদের সাজা দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

সে যাহোক, জাতীয় পর্যায়ে আগাম বুথফেরত জরিপগুলোর ফলাফলে দেখা গেছে, কমলা ৫৪ শতাংশ নারীর সমর্থন পেয়েছেন, যা ২০২০ সালে জো বাইডেনের পাওয়া সমর্থনেরও কম। ওই নির্বাচনে বাইডেন পেয়েছিলেন ৫৭ শতাংশ নারীর সমর্থন।

নির্বাচনী প্রচারে বেশি কৌশলী ট্রাম্প
গত শতকের সত্তরের দশকে আদালতের দেওয়া ‘রো বনাম ওয়েড’ রুলিং ২০২২ সালের জুনে বাতিল করে দেন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট। এ ঘটনা ছিল মার্কিন নারীদের গর্ভধারণের অধিকারের ক্ষেত্রে একটি টার্নিং পয়েন্ট। সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়কে দেশটির নারীদের অধিকার ও স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য এক বড় ধাক্কা হিসেবে মনে করে থাকেন অনেকে।

‘রো বনাম ওয়েড’ রুলিং উল্টে দেওয়ার বিষয়টি ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ছিল অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। সেবার নির্বাচনে জেতেন তিনি।

পরে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে নারীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হলে ডেমোক্র্যাটরা আশা করছিলেন, এবারের নির্বাচনে এ ইস্যু বড় প্রভাব ফেলবে। কমলাও তার নির্বাচনী প্রচারকে সেভাবেই সাজান।

প্রচারে কমলা গর্ভপাত নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য-বিবৃতিকে অনেক বড় করে টানেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কমলার নির্বাচনী প্রচার–সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনগুলোর একটির শিরোনাম ছিল, ‘পানিশমেন্ট (সাজা)’। এর মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের নির্বাচন-পূর্ব ট্রাম্পের একটি বিবৃতিকে বোঝান তিনি। ওই সময় ট্রাম্প যেসব নারী গর্ভপাত করবেন, তাঁদের সাজা দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

কমলা হ্যারিসের নীতি কীভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কল্যাণ করবে, সে বিষয়টি তার প্রচারশিবির ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি। অন্য কথায়, তারা ন্যূনতম এ বার্তা দিতে পারেনি, যা অধিকাংশ ভোটারকে সত্যিকার অর্থে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

তবে ওই বছর নির্বাচনে জিতে ট্রাম্প তার অবস্থান থেকে খানিকটা সরে আসেন। তিনি তার অবস্থানের ব্যাখ্যা দেন যে গর্ভপাতের প্রক্রিয়ায় যুক্ত চিকিৎসকের জন্য সাজা কার্যকর হবে। সাজা গর্ভপাত করা নারীর জন্য নয়।

চলতি বছরের নির্বাচনী প্রচারচলাকালে গত ২৯ অক্টোবর কমলা বলেন, ‘নারীদের গর্ভধারণের ওপরে নজর রাখতে অঙ্গরাজ্যগুলোকে বাধ্য করবেন ট্রাম্প।’ এ বিষয়ে ভোটারদের প্রতি ‘গুগল প্রজেক্ট ২০২৫’ ও ‘প্ল্যানস ফর ইওরসেলফ’ পড়ে দেখার অনুরোধ জানান তিনি। ট্রাম্পের কিছু সমর্থক এ নীলনকশায় রিপাবলিকান পার্টির রক্ষণশীল নীতি তুলে ধরেছিলেন। অবশ্য ট্রাম্প বলেছিলেন, এর সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। পরে কমলার ওই দাবিকে মিথ্যা বলে শনাক্ত করে সত্যানুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম পলিটিফ্যাক্ট।

এটা ঠিক, ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান সহযোগীরা নারীদের নিয়ে ‘যৌনতা-সংশ্লিষ্ট’ মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তবে নির্বাচনের আগে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে ফেডারেল নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি থেকে নিজেকে কৌশলে দূরে সরিয়ে রাখেন ট্রাম্প। বলেন, গর্ভপাত আইন নিয়ে সিদ্ধান্ত আলাদাভাবে অঙ্গরাজ্যগুলোর তরফে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

নির্বাচনী প্রচারে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার ইস্যুতে বেশি জোর দেওয়ার পরিবর্তে ট্রাম্প শ্রমজীবী মানুষকে নিশানা করে অর্থনৈতিক নীতির ওপর মনোযোগ দেন। আর এটিই ছিল তার প্রচারের মুখ্য অগ্রাধিকার পাওয়া বিষয়।

ট্রাম্পের রানিং মেট (ভাইস প্রেসিডেন্ট) জে ডি ভ্যান্স ২০২২ সালে বলেছিলেন, দেশজুড়ে গর্ভপাতবিরোধী নীতি সমর্থন করেন তিনি। কিন্তু গত জুলাইয়ে (বাইডেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে কমলাকে সমর্থন দিলে) ভ্যান্স বলেন, তিনি ট্রাম্পের এ ধারণার সঙ্গে একমত, গর্ভপাত এমন একটি ইস্যু, যা অঙ্গরাজ্যগুলোর আলাদাভাবে মোকাবিলা করা উচিত।

গর্ভপাত বিষয়ে না হলে কী নিয়ে উদ্বেগে ছিলেন নারীরা
নারী ভোটারদের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছিল কাইজার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন। গত ১১ অক্টোবর এ জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, এ নির্বাচনে নারীদের মধ্যে সার্বিকভাবে শীর্ষ অগ্রাধিকার পাওয়া বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি। এর মধ্যে ছিল গৃহস্থালির ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও। নারীদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি (৩৬ শতাংশ) বলেছেন, এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

জরিপে অংশগ্রহণকারী নারীদের কাছে এর পরের অগ্রাধিকার পাওয়া বিষয় ছিল ‘গণতন্ত্রের ওপর হুমকি’। এ মতের পক্ষে ছিলেন ২৪ শতাংশ। পরবর্তী অগ্রাধিকার পাওয়া বিষয়গুলো ছিল, যথাক্রমে অভিবাসন ও সীমান্ত নিরাপত্তা ও গর্ভপাত। অভিবাসন ও সীমান্ত নিরাপত্তায় জোর দিয়েছেন ১৩ শতাংশ নারী। আর গর্ভপাতকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন সমসংখ্যক নারী (১৩ শতাংশ)।

নারীদের কাছে নির্বাচনে কোন বিষয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে, তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত বুথফেরত জরিপেও একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে।

উপাত্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এডিসন রিসার্চের এক প্রাথমিক জাতীয় বুথফেরত জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, কাকে ভোট দেবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ৩১ শতাংশ ভোটার দেশের অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিপরীতে ১৪ শতাংশ গর্ভপাতের বিষয়ের কথা জানিয়েছেন।

কমলার কী ভুল ও ট্রাম্পের কী ঠিক ছিল
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার হ্যামলাইন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও লেখক ডেভিড শুলজ আল–জাজিরাকে বলেন, কমলা তাঁর প্রচারে ভোটারদের মনে চাপা পড়ে থাকা বিষয়গুলোর চেয়ে গর্ভপাতের ওপর অনেক বেশি মনোযোগ দিয়েছেন, যেমন অর্থনীতির মতো বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দেননি। অথচ নারীসহ শ্রমজীবী সব মানুষেরই আগ্রহের বিষয় এটি।

দেশের অর্থনীতিকে ভালোভাবে সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের সক্ষমতার ওপরই ভোটারদের আস্থা ছিল বেশি। দৃশ্যত, রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্পও তার অর্থনৈতিক নীতিতে শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে বোঝাতে বেশি সফল হয়েছেন। অন্যদিকে কমলা উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোটারদের কাছে টেনেছেন বেশি।

মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনের এক জরিপ অনুযায়ী, শ্বেতাঙ্গ উচ্চশিক্ষিত নারীদের ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ কমলাকে ভোট দিয়েছেন। বিপরীতে, উচ্চশিক্ষিত নন, এমন শ্বেতাঙ্গ নারী ভোটারদের ৬৪ শতাংশ ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন।

এআর

Wordbridge School
Link copied!