ঢাকা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে হোয়াইট হাউজে ফিরছেন ট্রাম্প। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। যার মধ্যে ছিল অর্থনীতি, অভিবাসন, কর ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়। জয়ের পরও তিনি বলেছেন, ‘আমি একটি সাধারণ লক্ষ্য নিয়ে দেশ পরিচালনা করব। সেটি হলো যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সেগুলো প্রতিপালন করা। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করব।’
বিবিসি বলছে, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি। এতে তার নিজের লক্ষ্যপূরণ আরও সহজ হবে। সে ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউজে ফিরে ট্রাম্প প্রথমে বেশ কিছু উদ্যোগ নেবেন। এ ছাড়া তার প্রতিশ্রুত কিছু বিষয় যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু, ন্যাটো, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে পরিবর্তন আসতে পারে।
অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে দেওয়া : নির্বাচনী প্রচারের সময় একটা কথা ট্রাম্প বারবার বলেছেন। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করবেন তিনি। এ ছাড়া মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। নিজের প্রথম মেয়াদে এই প্রাচীর তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। তবে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিকে কিছুটা বাঁকা চোখে দেখছেন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা। তারা মনে করেন, যে পরিমাণ অভিবাসীকে ট্রাম্প ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন, তা বাস্তবায়ন করতে গেলে তাকে বিশাল আইনগত ও লজিস্টিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এ ছাড়া এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির গতিও কমিয়ে দিতে পারে।
অর্থনীতিতে মনোযোগ : নির্বাচনের পরপরই বুথফেরত জরিপে দেখা গিয়েছিল, ভোটারদের কাছে অন্যতম বড় একটি বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতি থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে নিত্যপণ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণ উচ্চতায় উঠেছিল। বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বিদেশি পণ্যের ওপর নতুন অন্তত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে চান ট্রাম্প। আর চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়াতে চান অতিরিক্ত ৬০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে।
করনীতিতে পরিবর্তন : বেশ কিছু ক্ষেত্রে কর কমানোর প্রস্তাব করেছেন ট্রাম্প। সংখ্যার হিসাবে যা প্রায় ট্রিলিয়ন ডলার সমমূল্যের। প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে ২০১৭ সালেও তিনি একই ধরনের একটি করনীতি গ্রহণ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদশালীদেরই বেশি সুবিধা দিয়েছিল এই নীতি। ধারণা করা হচ্ছে, এবারও হয়তো সে রকমই কিছু ঘটবে। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কহার বৃদ্ধি করবেন।
জলবায়ুনীতিতে কাটছাঁট : ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পরিবেশ সুরক্ষাসংক্রান্ত নানা আইন বাতিল করেছিলেন ট্রাম্প। তখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রথম দেশ হিসেবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এবারও জলবায়ুনীতিতে কাটছাঁট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি শিল্পকে সহায়তা করা। ইলেকট্রিক গাড়ির বিরোধী তিনি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জীবাশ্ম জ¦ালানির উত্তোলন বাড়ানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প।
ইউক্রেন যুদ্ধ ও ন্যাটোর ভাগ্য ঝুলছে : রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইউক্রেনকে শত শত কোটি ডলার দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বরাবরই এর কড়া সমালোচনা করে আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
নির্বাচনী প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি ‘এক দিনের মধ্যে’ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। উত্তর আটলান্টিক প্রতিরক্ষা সামরিক জোটের (ন্যাটো) কার্যকারিতা নিয়ে ট্রাম্প আগেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। বড় ব্যবধানে জয়ী হয়ে আবারও হোয়াইট হাউজে ফিরে যাচ্ছেন ট্রাম্প। বৈদেশিক নীতি ও কৌশল বিষয়ে ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা আগে থেকে অনুমান করা খুবই কঠিন। তাই তিনি নিজের আগের মেয়াদের বিদেশনীতিতে এবারও অবিচল থাকবেন, নাকি পরিবর্তন আনবেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ‘ঘনিষ্ঠ’। বিবিসি বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অধিকাংশ সদস্য দেশসহ ইউরোপের নেতাদের বড় একটি দল উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠকে অংশ নিতে গতকাল বুদাপেস্টে একত্র হয়েছেন। উচ্চপর্যায়ের এই বৈঠকে মূলত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা হবে : ট্রাম্পকে কীভাবে মোকাবিলা করব? ব্রাসেলস থেকে শুরু করে ওয়ারশ পর্যন্ত ইউরোপীয় দেশগুলো ট্রাম্পের বিজয়ের পর এখন ভাবছে, তার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সি ইউরোপের জন্য কী তাৎপর্য বয়ে আনবে?
ইউরোপের অনেক দেশ ইতিমধ্যেই নানা অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। নির্বাচনী প্রচারের সময় ট্রাম্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রে আসা সব বিদেশি পণ্যের ওপর ট্যারিফ আরোপ করা। যদি এই পরিকল্পনা কার্যকর হয়, তাহলে ইউরোপের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য সেটি বিশাল ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এ ছাড়া, চীনবিরোধী কঠোর নীতির ফলে ইউরোপে বেইজিংয়ের বাণিজ্য প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় চীন বাজারে নতুন করে সস্তা পণ্য নিয়ে আসতে পারে। এটি বাজারে চলমান প্রতিযোগিতাকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
শুক্রবার (৮ নভেম্বর) ইইউ নেতারা এক অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে একত্র হয়ে ‘নতুন ইউরোপীয় প্রতিযোগিতামূলক চুক্তি’ নিয়ে আলোচনা করবেন। ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি তার প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করেন। দ্রাঘি এবং ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লেগার্ডও সম্মেলনে অংশ নেবেন।
মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব : বিশ্লেষকরা বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্য নীতির অন্যতম প্রধান বিষয় হবে গাজা ও লেবাননের যুদ্ধ শেষ করা। পাশাপাশি, ইসরায়েলকে আরও গভীরভাবে মধ্যপ্রাচ্যে একীভূত করাও মধ্যপ্রাচ্য নীতির শীর্ষে থাকবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব নেওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য তার আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় হতে পারে। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করেন, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব মেনে নেন।
এ ছাড়া, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শতাব্দীর চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন এবং ইরানের ওপর চাপ বাড়ান। তবে, ২০২১ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব ছাড়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনগুলো নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কীভাবে সামলাবেন, তা জানতে আগ্রহী অনেকেই।
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও ট্রাম্পের জয়ে সমর্থন জানিয়েছে। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত ট্রাম্পের জয়ে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে, ‘আমরা একে অপরকে সহযোগিতার শক্তিশালী সম্পর্কের ভিত্তিতে একসঙ্গে এগিয়ে যাব।’
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতি খুব একটা গুরুত্ব না দেখিয়ে ইরান বলছে, যেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোক না কেন, কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। বুধবারের ভোটের পর ইরানের সরকারি মুখপাত্র ফাতেমা মোহাজেরানি ইরানি গণমাধ্যমে বলেন, আমেরিকা এবং ইরানের সাধারণ নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
গর্ভপাতের অধিকার রদ : নিজের কিছু সমর্থকের ইচ্ছার কথা মাথায় রেখে কমলা হ্যারিসের সঙ্গে নির্বাচনী বিতর্কের সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে গর্ভপাতের অধিকার রদ-সংক্রান্ত আইনে স্বাক্ষর করবেন না। ২০২২ সালে গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকারকে খারিজ করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট। ওই রায়ের পক্ষে ছিলেন আদালতের রক্ষণশীল বিচারপতিদের অধিকাংশ।
ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে কঠোর নীতি : ২০১৬ সালে জয়লাভের পর ট্রাম্প ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি এমনটাও বলেছিলেন, দেশটির সেনাবাহিনীতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কোনোভাবেই কাজ করতে পারবে না। কিন্তু তার আগে ওবামা প্রশাসন সেনাবাহিনীতে প্রকাশ্যেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করার নীতি নিয়েছিল। এবার ট্রাম্প আবারও হোয়াইট হাউজে ফেরার পর ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে আগের মতো নীতিতেই ফিরে যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আদালতের বাধার সম্মুখীন হতে পারেন সদ্য নির্বাচিত এই প্রেসিডেন্ট।
এমটিআই