ঢাকা: “পৃথিবীতে আসার সময় প্রতিটি মানুষই একটি করে আলাদিনের প্রদীপ নিয়ে আসে…কিন্তু খুব কম মানুষই সেই প্রদীপ থেকে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাতে পারে।”
উক্তিটি পড়লে প্রথমে আপনার কপালে ভাঁজ পড়তে পারে। কারণ, খুব সাধারণ বাক্যে গভীর বোধের কথা উক্তিটিতে বলা আছে। আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে নিগূঢ় কথাটি কে বলেছেন এত সহজ করে। উক্তিটি আর কারও নয়, বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি, যাকে আমরা তারুণ্যের প্রতীক ‘হিমু’ এবং রহস্যের আলো-ছায়ায় আবৃত ‘মিসির আলি’র স্রষ্টা বলে চিনি।
আজ বিংশ শতাব্দী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৯ম প্রয়ান দিবস। তিনি ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। হুমায়ূন সহজ-সরল ভাষার মধুরতায় সৃষ্টি করেছেন এক নান্দনিক মায়াজাল। যার মায়াজলে আবৃত হয়ে আছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। চলুন এই প্রজন্মের চোখে হুমায়ূনকে একটু দেখি।
আমার দেখা হুমায়ূন আহমেদ
১৯৮৯ সাল। তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। অজোপাড়া গা’য়ের এক স্কুলে যাওয়া-আসা আর টেবিলে মাথা গুজে পাঠ্যবই পড়ার মধ্যে আমার জীবনচক্র আবদ্ধ। পাঠ্যবইয়ের লেখক পরিচিতিতে পাওয়া বড় মনিষীদের বিষয়ে ছাড়া আর কিছুই জানি না। আমার কাছে তখন থানার এটিও সাহেবরা অনেক বড় ব্যক্তি। বলা যায় তারা আমার স্বপ্ন। সেই সময়ে ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ি কেন্দ্রিক গ্রাজুয়েট এসোসিয়েশন এক বৃত্তির আয়োজন করে। সেখানে কেন্দুয়া, তাড়াইল, নান্দাইল, গৌরিপুর ও ঈশ্বরগঞ্জের ভাল ভাল স্কুলের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসে। কেন্দুয়ার সান্দিকোনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমরাও সাত-আটজন আসি। বড় পরিসরে নিজের যোগ্যতা মাপতে এসে বাজিমাত করলাম। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে গেলাম। কিছুদিন পরে এলো বৃত্তির চেক প্রদানের পালা। শুনলাম বিখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ আসবেন চেক দিতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমি ভদ্রলোককে চিনি না। কারণ, পাঠ্যবইতে তার কোন লেখা পড়িনি। এলাকাতেও তার খুব একটা হাঁকডাক নেই। যেহেতু পাঠ্যবইয়ের বাহিরে আমার পড়ার কোন অভিজ্ঞতা নেই আমি তার মূল্য বুঝিনি। তাই পুরস্কার গ্রহণ বাদ দিয়ে মামাবাড়ি বেড়াতে যাই। যার কাছে যেটার মূল্য বেশি।
হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করতে না পারার আক্ষেপটা ঘুচল ১৯৯৩ সালে। তখন আমি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে একাদশে ভর্তি হই। গিয়ে দেখি সব পোলাপান হুমায়ূনের ভক্ত। আমি নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার বাসিন্দা শুনে তারা সকলে আমায় কিছুটা সমীহ করতে লাগল। হুমায়ূনের এলাকার কাউকে পেয়েছে এতেই তারা খুশি। আমি মনেমনে বলি, কে গো এই ব্যক্তি, যার জন্য তোমরা এত উন্মাদ। তার মধ্যে একদিন হুমায়ূনের লেখা একটি বই হাতে পেলাম। পড়তে লাগলাম। বিমুগ্ধ হতে হতে আত্মহারা প্রায়। কোন মতে আত্মা নিয়ে বেঁচে রইলাম। কারণ, তার লেখা পড়ে এতই মুগ্ধ হলাম যে আমাকে উন্মাদনায় পেয়ে বসে। এত মজা করে কেউ লেখালেখি করতে পারে!
আমার মনের কথা তিনি এমন করে প্রকাশ করতে পারলেন! ইশ, সেদিন তার হাত হতে পুরষ্কার না নিয়ে কী ভুলটাই না করলাম। যদি আরেকবার সুযোগ পেতাম! অন্তত তাকে চেয়ে চেয়ে দেখতাম।
সুযোগ এসে গেল। আমাদের অভিভাবক দিবসে তাকে প্রধান অতিথি করে ডাকা হলো। আমার তাকে দেখার অপেক্ষার তর সইছে না। কলেজের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে হুমায়ূন উন্মাদনা। অনেকের ধারণা হুমায়ূন আহমেদ আমাকে দেখলে চিনতে পারবেন। তাছাড়া আমার নেত্রকোনার আঞ্চলিক টোন শুনতে পেলে হুমায়ূন আহমেদ খুশি হবেন। তার দেশী হওয়ায় গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। আমরা যথাসময়ে কলেজের নিয়ম মেনে মঞ্চের সামনে হাজির হলাম। অপেক্ষায় আছি আমার এলাকার মানুষটির জন্য। দুপুর ১টায় তার আসার কথা। কিন্তু তিনি আসলেন না। সবার সাথে আমিও হতাশ হলাম। মানুষটিকে দেখব না? মাইকে ঘোষণা আসল, ‘আমাদের অতিথি আসতে দেরি হবে বিধায় প্রোগ্রাম ২টায় শুরু হবে।’ আশস্ত হলাম দেরি হলেও তিনি আসবেন।
এক সময়ে দু’টাও বেজে গেল, কিন্তু অতিথির খবর নেই। শুধু এটুকু জানা গেল যে তিনি বাংলা একাডেমিতে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করছেন। একই ভাবে আগের মতো মাইকে ঘোষণা এলো। এবার প্রোগ্রাম সেট করা হলো ৪টায়। এদিকে অভিভাবকরা বিরক্ত। কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। আমাদেরকেও আর সুশৃঙ্খল ভাবে ধরে রাখা যাচ্ছে না। মুক্ত মাঠ পেয়ে আমরা এলোমেলো হতে লাগলাম। প্রোগ্রামের অবয়ব কিছুটা অগোছালো হতে শুরু করল। এভাবেই বারবার সময় পালটিয়ে অধ্যক্ষের চেহারা লাল করে বিকেল পাঁচটায় সম্মানিত অতিথি কলেজে এসে হাজির হলেন। এসেই তিনি ক্ষমা চাইলেন। সকলের মুখে প্রশান্তি। কিসের দেরি, কিসের কষ্ট! সবাই তাদের রাগ ভুলে গেল। হুমায়ুন এসেছেন তার চেয়ে আনন্দের কি আছে! সত্যি সারা ক্যাম্পাসে যেন আনন্দের দোলা লেগেছে। শুরু হলো প্রোগ্রাম। অন্যদের কথা আর ভাল লাগছে না। অপেক্ষায় আছি তার কথা শুনার জন্য। অবশেষে তিনি তার ফ্লোর পেলেন। আমরা শুরুতেই সমস্বরে হুমায়ূন স্যার বলে চিতকার দিয়ে উঠলাম। আকাশ-বাতাস কি কেঁপে উঠেনি? কাঁপবে না কেন? তিনি তো লেখনীতে বাংলার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়েই গেছেন।
শুরু হলো মহান মানুষটির কথা বলা। কালিকলমে নয়, নয় কাগজে, আমরা শুনছি সুদর্শন জোয়ান মানুষটির নিজের মুখে বলা কথা। অনেক চাওয়া তার কাছে। তিনি আমাদের আজ অভিভূত করবেন। কথায় ভাসিয়ে দেবেন। কথা শুনে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ব আমরা। মুগ্ধতার আবেশ ছড়ানো কম্পনে কেঁপে উঠবে সকলে। এক বিশাল চাওয়া। কিন্তু তার কথা শুনে সেই কল্পনার মানুষটিকে পেলাম না। তিনি কথা বলতে গিয়ে নিজেই কাঁপতে লাগলেন। সে কথা তিনি নিজেও জানালেন। তিনি বললেন, বড় মঞ্চে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দু’এক কথা বলে তাঁর বক্তৃতা শেষ করে দিলেন তৃপ্ত হলাম না আমি বুঝে গেলাম, কলমের কথা আর মুখের কথা এক ছন্দে নাও চলতে পারে। মঞ্চ আর বই সম তালে কথা বলেনা। তবুও আমরা সকলে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ। কেননা আমরা আমাদের মহানায়ককে স্বচক্ষে দেখলাম।
তিনি বক্তৃতা করতে পারেন না, তাতে কি? কলম দিয়ে আমাদের হয়ে কথা বলেছেন, আমাদের মনের না বলা কথা তিনি অবলীলায় বলে গেছেন, তার কথা তো তার নয়, আমাদের সকলের মনের কথা। যদি আমার মনের কথা কারও কলমে উঠে আসে তার চেয়ে আনন্দের কি আছে? দরকার নেই মঞ্চে কথা বলার। আপনার বই কথা বলছে আমাদের মনের মঞ্চে। বলতে থাকুক চিরকাল।
প্রফেসর ড. এ, এইচ, এম, কামাল
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমার চোখে হুমায়ূন আহমেদ একজন অনন্য কথাসাহিত্যিক। যিনি অতি সহজেই একটা চরিত্রকে আমাদের ভিতর থেকে বের করে আনতে পেরেছেন । তিনি হাসতে হাসতে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং স্যাটায়ার টুইস্টের মাধ্যমে পাঠককে অবগাহন করাতে পেরেছেন ভালোবাসার সাগরে। নিজেও ভেসেছেন সেই অবারিত পরম মমতায়, পরম ভালবাসায়।
তবে আমরা একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই তার সারাৎসার অনুধাবন করতে পারি। যে চরিত্রের কথা আমাদের মাথায় কখনো আসেনি, সেই চরিত্র তার মাথায় চট করে খেলা করে গেছে। তার বড় গুণ তিনি খুব সহজেই মানুষের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছেন। যে কারণে, তিনি প্রচুর পাঠককে নিজের দিকে টানতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বিষণ্ণ বা হতাশাগ্রস্ত মানুষকে যেন তার উদাসীনতার সঙ্গী করেছেন। তার সম্মুখে খুলে দিয়েছেন সম্ভাবনা। তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অসংগতিগুলোই তিনি হাসতে হাসতে দেখাতে চেয়েছেন। যে কারণে আমরা বলতেই পারি তিনি লেখক হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে একজন অনন্য।
বঙ্গ রাখাল
লেখক, কলামিস্ট এবং গবেষক
‘মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে যাদুধন
মরিলে কান্দিস না আমার দায়,
সুরা ইয়াছিন পাঠ করিয়ো বসিয়া কাছায়
যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায়।
রে যাদুধন, মরিলে কান্দিস না আমার দায়.....’
স্যার,
আপনার কাছে বসে সূরা ইয়াসিন পাঠ করার সুযোগ আমার হয়নি। তবে আমি নিয়ত করছি জীবনে যতদিন বেঁচে আছি যতবার সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবো তার সওয়াব যেন আপনার রুহের মাগফেরাতের জন্যও লিখা হয়।
আজ ১৯ জুলাই, ২০২১। প্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর ৯ম মৃত্যু বার্ষিকী। অসংখ্য গল্প উপন্যাসে গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নায় আমাদের স্নান করানো মানুষটি চলে গিয়েছিলেন অনাকাঙ্ক্ষিত এক অমাবস্যার রাতে।
‘হুমায়ূন আহমেদ’ বাংলাদেশে বাংলা বই পড়ার প্রতি যিনি, নতুন করে আগ্রহের জাগরণ সৃষ্টি করে গেছেন! প্রার্থনায় বেঁচে থাকুন। ওপারে ভালো থাকুন।
কবি সালমান হাবীব
স্বাধীনতা পরবর্তী গণমানুষের এলোপাতাড়ি জীবনযাবনে বই পড়ার অভ্যাস থেকে পড়ার নেশা এবং আসক্তি তৈরি করার মূলমন্ত্রটি হুমায়ুন আহমেদ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তার লেখা, গান, সিনেমা, নাটকের মাধ্যমে।
সদ্য বাংলা পড়তে জানা সাত বছরের শিশুটির সাহিত্য পড়ার হাতেখড়ি থেকে শুরু করে তরুণ বয়সীর সাহিত্য পরিচিতি, যৌবনে সাহিত্যরসে জীবনকে নিমজ্জিত করানো, মাঝবয়েসীর সাহিত্য নিয়ে গবেষণা-সমালোচনা এবং ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধের কালক্ষেপণের অন্যতম মাধ্যম হলো হুমায়ুন আহমেদের বহুমাত্রিক সৃষ্টিকর্মগুলি।
তার লেখা উপন্যাসের ‘পাঠক’ হতে না পারলেও বা না চাইলেও তার সিনেমা, গান, নাটকের ‘দর্শক’ হয়ে আত্মসমর্পণ করতেই হয় মানুষকে। কেউ চাইলেও যেনো হুমায়ুন আহমেদ থেকে নিজেকে তফাতে রাখার সুযোগ পায়না কারণ স্বাক্ষর, নিরক্ষর, শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষা বিমুখ- কমবেশি সবাই কোনো না কোনো বিকল্প মাধ্যমের কল্যাণে হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্টিসুরা পান করেই চলেন জীবনব্যাপী। একাধারে এই পাঠক এবং দর্শক নন্দিত মানুষটির কোনো মৃত্যু নেই।
রুকাইয়া পাখি
কবি ও শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ সম্পাদক, চিরকুট
হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন মানুষ, যিনি নিজের জন্য উন্নত ক্ল্যাসিক সাহিত্য পছন্দ করলেও তার লেখায় ফুটে উঠেছে সাবলীলতা। সাবলীল লেখার জন্যই তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। সাহিত্যকে নিয়ে এসেছেন পাঠকের দোরগোড়ায়। তার সমৃদ্ধ লেখা এমন এক প্রজন্ম সৃষ্টি করেছে যারা বইপ্রেমী হয়ে উঠেছে। তার সৃষ্টিকর্ম লেখক তৈরি করেছে। সাহিত্যচর্চার প্রতি ঝোঁক বৃদ্ধি করেছে তার অনবদ্য লেখনী। মিসির আলী, হিমুর মতো চরিত্র বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তিনি শিখিয়েছেন বৃষ্টিবিলাস, জোছনাবিলাস। চরিত্রকে বইয়ের পাতা থেকে টেনে যেন প্রাণ দিতে চেয়েছেন। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটক তারই প্রতিফলন। বইয়ের ভাঁজ থেকে উঠে পর্দার আড়ালে থেকেও যেন বাস্তব হয়ে উঠেছিল সাধারণের মনে। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিকর্মে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
ফারজানা ববি
কবি ও কথাসাহিত্যিক
সাত বছরের শিশুর তখন বয়েসটা বোধ করি টেলিভিশনে বিটিভির যুগে উডি উডপেকারের জন্য অপেক্ষা আর বাইরের পড়া পড়তে গেলে চাচা চৌধুরীর কমিক বইই হওয়া উচিৎ ছিলো। ঘটনাক্রমে আমার বেলা একটু ব্যতিক্রম হয়ে গেলো।
শুক্রবারের সেই এক ছুটির দিনে বাড়িওয়ালী আন্টির ছোট মেয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে খুঁজে পাই কালো মলাটের একটা বই। আপুর বয়েস তখন পনেরো কি ষোল। ছটফটে কিশোরী।
যেই বইটা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম তখন, সেই বইয়ের নাম ‘কালো জাদুকর’। তা, জাদুকরের সেই বইয়ের লেখকের নাম বোধ করি বলতে হবে না। সবাই জানেনই। প্রিয় হুমায়ূন। সেই শুরু, এক বসায় বইটা শেষ করতে জাদুকরের জন্য কাঁদা। আহা, বেচারা টগর! আহা, অন্ধ গাছটা! অন্ধ সেই গাছটার জন্য প্রগাঢ় মায়া আমাকে ঘিরে রইলো এরপর থেকে।
বহুবার কাঁদালেন তিনি আমায়। সেই সেবার যখন মাঝ পুকুরে দিলুর নিথর শরীরটা ভাসছিলো, তখন কেঁদেছি। অভিমানী কুসুম বিষের শিশিটা যখন গলায় ঢেলে নিলো- কিংবা যখন জনমদুঃখী অপালা বাবার সোনারিলের শিশির সবকটা ট্যাবলেট গিলে ফেললো; তখন কেঁদেছি। কাঁদিনি কখন?
বাকের ভাইয়ের ফাঁসি, মন্টুর ফাঁসি, ছোট্ট টুনির মৃত্যু - কেঁদেছি বহুবার। কত শতবার নীল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রূপা কিংবা সবুজ শাড়ি পরে নিশাত হবার চেষ্টা! আহা মায়া! আহা!
সাত বছরের শিশু কন্যা কিশোরী হলো একসময়। আজ সে একুশ বছরের তরুণী। অথচ জাদুকরের মায়াটা আজও কাটলো না। মেয়েটির খুব গহীনে একটা দরজা আছে। সে দরজার এপাশেও হুমায়ূন, ওপাশেও।
রোকেয়া আশা
কবি ও গল্পকার
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আমার চোখে হুমায়ূন মানে সেই স্কুল পড়ুয়া ছোট্ট কিশোরী, যে কিনা হুমায়ুন পড়ার নেশায় স্কুলের পড়া যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করে বসে পড়তো উনার বই নিয়ে। কখনো হিমুর ময়ূরাক্ষী নিয়ে কল্পনায় হারানো, কখনো শুভ্রর মতো শুদ্ধ চিন্তায় বুদ বা কখনো মিসির আলির একেক রহস্যের বেড়াজালে মগজের গভীর অনুরণন। উনি আমায় শূন্য থেকে কখনো তন্দ্রাবিলাস কখনো শঙ্খনীল কারাগারে নন্দিত নরকের জ্বালা বুঝিয়েছেন, উনি বুঝিয়েছেন মনের দেয়াল কতোটা উপকারী হতে পারে। উনি চিনিয়েছেন বন্ধুত্ব, অপেক্ষারা কিভাবে পদ্ম পাতার জলের মায়ায় দারুচিনি দ্বীপ অবধি যায় যে দীর্ঘ পথ উনি চিনিয়েছেন। উনি বুঝতে শিখিয়েছেন আপনি ছাড়া আসলেই আর কোথাও কেউ নেই সবই মায়া।
মহসিনা সরকার
কবি ও শিক্ষার্থী
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমার কাছে গল্প মানেই হুমায়ূন আহমেদ, আর হুমায়ূন আহমেদ মানেই শব্দ বিন্যাসের কারিশমা। ছোটো প্লটে এত নিখুঁত বর্ণনা, সাইকোলজিক্যাল খেলায় নিখুঁত পারদর্শী এবং কথার কারিগর খুব কমই চোখে পড়েছে। মূলত হুমায়ূন আহমেদ পড়েই গল্প বলতে শিখেছি। গল্প বলার ঢং, মনস্তাত্ত্বিক খেলা, দ্বিধার দোলাচল, ঘটনার মোড় ঘুরানো সবই তার কাছে শেখা। মৃত্যুদিবসে এই মহান কথাশিল্পীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
সুজন আহসান
কবি ও কথাসাহিত্যিক
হুমায়ুন আহমেদের সমাধিতে আনমনে ভাবতে ভাবতে তন্দ্রায় গিয়েছি। হঠাৎ দৈব কণ্ঠে শুনতে পেলাম-
: হিমু.!হিমু.!
: কে? কে বলছেন আপনি?
: আমি কারিগর হিমু বানানোর কারিগর।
: কিন্তু আমি তো শান্ত আমাকে হিমু বলে ডাকছেন কেনও?
: তুমি হিমু।
: নাহ আমি শান্ত।
: না তুমি হিমু।
: না আমি হিমু নাহ। দেখুন আমি লাল গেঞ্জি পড়া,আমি জুতা পরেছি। আমি হিমু নাহ।
: তুমি হিমু।আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার ভিতর হিমু হওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা।তুমি হিমু।
: কিন্তু আমি তো খালি পায়ে হাটি না? হিমুদের মতো সব কিছু বিসর্জন দেই না বা জ্যোস্না দেখে তাকিয়েও থাকি না। আমি হিমু হবো কিভাবে?
: তোমার মনের তীব্র বাসনা তোমাকে হিমু বানিয়েছে।
আমি বললাম নাহ আমি হিমু নাহ,আমি হিমু নাহ প্রোক্ষণেই আর জবাব পেলাম না। ঘোর কেটে যাওয়ার পর দেখলাম আমি হুমায়ুন স্যারের কবরের সামনে আম গাছের পারে বসে আছি। বিনম্র শ্রদ্ধা হে প্রিয় কথাসাহিত্যিক।
সাজেদুল আবেদীন শান্ত
কবি ও সাংবাদিক
আমার চোখে হুমায়ূন আহমেদ।
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল যখন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন সেখানে শুধু শিক্ষিতরাই নাগরিক হিসেবে গণ্য হতো।কালের পরিবর্তনে সেই সংজ্ঞা বিলুপ্ত হয়। আব্রাহাম লিংকন নিয়ে আসেন সবার জন্য সমান একটি শাসনব্যবস্থা।
বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই ঘটনার একটা মিল পাওয়া যায়।বাংলা সাহিত্যের যত নামকরা লেখকরা আছেন, রবী ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং
তাদের মতো আরও যারা ছিলেন তাদের লেখা পড়ে সেটা বোঝা এবং অনুভব করা সকলের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।ফলে পাঠকের সংখ্যা ছিল অনেক কম।শখের বসে বই পড়া কিংবা বইপড়াকে একটি ভালোলাগার কাজ হিসেবে নেয় এমন মানুষ ছিল হাতেগোনা। এই বাংলা
সাহিত্যকে সবার দ্বারে যে মানুষটি পৌঁছে দিয়েছেন তিনি হুমায়ূন আহমেদ।তাঁর লেখা পড়েই সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম শখের কাজগুলোর মধ্যে বই পড়া এখন প্রধান একটি কাজ।পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। পাঠক বাড়াতে বেড়েছে বইয়ের চাহিদা। আমরা পেয়েছি আরও অনেক লেখকদের।যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলা সাহিত্যের পরিসর দিনদিন সম্প্রসারিত হচ্ছে যার পেছনে অবদান প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ স্যারের।
২০১২ সালের আজকের দিনে স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।তবে আমাদের মনে তিনি বেঁচে আছেন।তার অমর সৃষ্টিগুলো সবসময় আমাদের মনে থাকবে।।
আসিফ খন্দকার।
কবি ও সম্পাদক
বাংলা সাহিত্যে এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। সাহিত্য থেকে দূরে সরে যাওয়া একটি জাতিকে সাহিত্য মুখী করেছেন তিনি। তরুণ-তরুণীদের বইপোকা বানিয়েছে উনার লেখা বইগুলো। উনার সহজ ভাষায় গল্প বলার ধরনটা আকৃষ্ট করেছে পাঠক সমাজকে। হিমু-রুপা’রা হলুদ পঞ্জাবী-নীল শাড়ী পরে এখনো হেঁটে বেড়ায় শহর থেকে গ্রামে। পাঠকরা উনার গল্পের চরিত্রগুলোকে এমনই ভাবে ঠাঁই দিয়েছে নিজেদের মাঝে যেন বাস্তব রূপ। এটাই উনার সাহিত্যের সফলতা। এখনকার লেখকদের অনুকরণীয় হয়েছে তার লেখা। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ুন আহমেদের প্রয়োজনীয়তা থেকে যাবে চিরদিন। ভালো থাকবেন ওপারে কথার জাদুকর।
সুজন খান
চলচ্চিত্র কর্মী
হৃদয় ভুবনে তিনি
নৈঃশব্দ্যের আহাজারিতে হৃদয় মন্দিরে একটা শূন্যতা খুঁজে বেড়ায়; খুঁজে বেড়ায় একটা অপূর্ণময় শূন্যতা। ভাববিলাসী মন সমুদ্রের আঘাতে মেঘবালক হয়ে ঝরে পড়ে ঝর্ণাধারায়। জীবনের মায়াকাননে ছায়া দেবতা আজও ছায়ামূর্তি হয়ে আগলে রাখে। স্বপ্ন জাগানিয়া মহাজাগতিক মানুষ হিসেবে হৃদয় স্পর্শ করেছে তার কর্ম। তিনি হুমায়ূন আহমেদ।
তিনি নিজেই এক আলোক নগরী। তার ভেতরে যেই প্রবেশ করে সেই হয়ে ওঠে আলোকবর্তিকা। কখনও পরশ পাথর স্পর্শ করিনি; চোখেও দেখিনি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে দেখলে পরশ পাথর দেখা হয়ে যায়। তার কর্ম স্পর্শ করলে পরশ পাথর স্পর্শ পাওয়া যায়। তার আলোকস্ফূরণ অনবদ্য সবার থেকে আলাদা। নিজেই গড়েছেন আলোকময় সে ভুবন। হৃদয় ভুবনে তিনি রবে নীরবে।
ফরিদুল ইসলাম নির্জন
কথাসাহিত্যিক
আমি অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন প্রথম হুমায়ুন আহমেদের একাটি উপন্যাস পড়ি। বইটার নাম ছিল ‘লীলাবতী’। লীলাবতী পড়ার সময় এবং পড়ার পর আমি যেন স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এভাবে হুমায়ুন আহমেদের বই পড়া শুরু হয়। আসলে আমার চোখে হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন যাকে ধারণ না করলে কেউ কখনো অনুভব করতে পারবে না। তার সাবলীল প্রতিটি লেখায় মুগ্ধতা ছাড়িয়ে যায়। তার অধিকাংশ বইয়ে হাস্যরসাত্মক কথোপকথনে ফুটে উঠে সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিশাল সংখ্যার তরুণ সমাজ তার বই পড়ে প্রভাবিত। তিনি সবার মাঝে এক অন্যান্য, অনবদ্য। তিনি বেঁচে আছেন পাঠকদের মনে, কিংবদন্তীরা কখনো হারিয়ে যায় না। তারা বেঁচে থাকেন কালজয়ী হিসেবে, বেঁচে থাকেন হাজারো মানুষের অন্তরে।
কাজী আর্জিনা
পাঠক এবং শিক্ষার্থী
আপনার মতামত লিখুন :