কেউ পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না, অভিযোগ ‘দলাদলির’

  • নোয়াখালী প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
কেউ পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না, অভিযোগ ‘দলাদলির’

ফেনী : অগাস্টের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ত্রাণ নিয়ে ছুটছে মানুষ; ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, স্থানীয় তরুণ আর রাজনৈতিক দলের ব্যানারেও সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছেন অনেকেই।

তারপরও বন্যাকবলিত ফেনীতে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, ত্রাণ বিতরণ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আর বিএনপি সমর্থিতদের মধ্যে বেঁধেছে বিপত্তি। কে, কোন দলের, সেটি বিবেচনা করে দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ। আওয়ামী লীগের কেউ বন্যাকবলিত হলেও সেখানে যাচ্ছে না বিএনপির কেউ। অভিযোগ উঠেছে দলাদলির।

নোয়াখালী সদর উপজেলার দিনমনির বাজার হয়ে হাঁটু পানি মাড়িয়ে কিছুদূর এগোলেই আজিজুল্লাহপুর গ্রাম। শুক্রবার (৩০ আগস্ট) সেখানে গিয়ে দেখা গেল, মূল পথের পুরোটাই এখনও পানির নিচে। রাস্তার দুই পাশের বাড়িগুলোতেও হাঁটু পানি।

প্রায় ১২ দিন ধরে পানিবন্দি এ গ্রামে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দিনমজুর আর মধ্যম আয়ের মানুষগুলো বেশি বিপাকে।

যারা ত্রাণের জন্য রাস্তায় দাঁড়াচ্ছেন, তাদের কেউ কেউ পাচ্ছেন। যারা দাঁড়াচ্ছেন না, তারা কিছু্ই পাচ্ছেন না। খেয়ে, না খেয়ে অথবা শুকনো খাবারেই কাটছে অনেকের দিন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গ্রামে ত্রাণ বিতরণের তদারকি করছেন স্থানীয় তরুণরাই। বাইরের সংগঠন এসে ত্রাণ দিয়ে গেলেও তালিকা করে তা বিতরণের কাজটি স্থানীয়রাই করছেন।

তাদের অভিযোগ, ত্রাণ এলেও আজিজুল্লাহপুরের কেউ পাচ্ছে, আবার কেউ পাচ্ছে না। চলছে ‘দলাদলি’।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, এহন আবার সিন্ডিকেটও চলে এইডা লই। কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি। দেহা গেছে কেউ কেউ বইক্তব্য দেয়, আওয়ামী লীগের কোনগা যাতে এহানে না থাকে।

এরপরে চাই আওয়ামী লীগেরগুনও আই ভাগ করে। আওয়ামী লীগ বিএনপির এহানে ভাগাভাগির দরকার নাইতো। বন্যায় সবাই সমান। হেতে আওয়ামী লীগ, হেতে এহানে দাঁড়াইতাইত্তোনো; হেতে বিএনপির, হেতে এহানে দাঁড়াই মুস্তানি কইত্তে অইবো, কইরবো। এগুন কিল্লাই?

এলাকায় ত্রাণ বিতরণ বিএনপির লোকজন করছে জানিয়ে ওই ব্যক্তি বলেন, আওয়ামী লীগের কেউ আসতে পারে না। তবে ছাত্ররাই আসছে বেশি।

তার ভাষ্য, আমার বলাতেই বুইজবেন। মাইরেই বুইজবেন আমনে থাইকবেন না চলি যাইবেন। আই আগেই কইদিলাম আওয়ামী লীগের কোনগা যাতে ইহানে না থাহে। তাইলে আমনের বুইজতে অইবো, আমি বিএনপি করি, নয়তো জমাত করি।

আবার আমি কিছু নিলে আওয়ামী লীগের লোকজন কয় আমি বিএনপি করি, দালালি করি খাই। এইডা তিক্ততা না ভাইয়া? মিলিমিশি দিলেতো হয়, আওয়ামী লীগ বিএনপির হিসাব পরে।

আজিজুল্লাহপুর এলাকার ত্রাণ কার্যক্রম যারা দেখভাল করছেন, তাদের অন্যতম নোয়াখালী সদর উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সাজীব। তার বাড়ি আজিজুল্লাহপুর এলাকাতেই।

ত্রাণ কার্যক্রম কেমন চলছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার এলাকায় কোনো প্রবলেম হইতেছে না। একটু ভিতরের দিকে ত্রাণ নিয়ে অনেকে পৌঁছাইতে পারতেছে না। তবে আমরা চেষ্টা করতেছি, সবখানেই পৌঁছাইছি।

এখনও ত্রাণ দিতে দুয়েকটা গ্রাম বাদ আছে। আমরা চাইতেছি এইটার সুষম বণ্টন হোক, সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করতেছি।

আওয়ামী লীগের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এরা ত্রাণ বিতরণ করুক তা সাধারণ মানুষ চাইতেছে না। যেমন একজন সাবেক মেম্বার, সবাই বলতেছে এতদিন আসে নাই, এখন আসছে কেন? সাধারণ লোকজনই তাদের একসেপ্ট করছে না।

দলের অনুসারী বেছে ত্রাণ দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কে কোন দলের সেটা বাছবিচার করছি না। এই দুর্যোগ কোন দলের না, আওয়ামী লীগের না, বিএনপির না, জামায়াতের না। এটা সর্বসাধারণের দুর্যোগ।

আমরা প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছি। যে এই সহায়তা পায় না, তাকে আমি নিজে পৌঁছায়ে দিচ্ছি। হয়ত সংকটের কারণে পাঁচজনকে দিতে পারছি, একজনকে পারি নাই। উল্টা আমার দলীয় লোকজনও আমাকে বলছে, আওয়ামী লীগের লোকজন বেশি পাচ্ছে। অনেক নেতার কাছ থেকে কথা শুনতে হচ্ছে, তারা মাঝেমধ্যে বলতেছে এসব। কিন্তু আমি বলছি এই দুর্যোগ আওয়ামী লীগ বিএনপির বিষয় না।

কিল্লারহাটের এক ব্যবসায়ী বলেন, তারা ব্যচমেট বন্ধুরা মিলে একটা ফান্ড গঠন করে কাজ করছিলেন। একসঙ্গে যারা কাজ করছিলেন তাদের একজন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচন করবেন। সেই বন্ধু তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে তাকে এড়িয়ে একাই কাজ শুরু করেন।

নাম প্রকাশ না করে এ ব্যবসায়ী বলেন, আঁর কাছে আরও প্রায় ৩০ হাজার টাকা আছে। আমি চুপচাপ বসি রইছি, কয়দিন কইচ্ছি। আর কইত্তান্নো।

বন্যার সময় অনেকেই এইটা-সেইটা নি আসতেছে। বন্যার পরে মানুষের আসল অভাব শুরু হইব। তখন কারো বাড়ি ঠিক করা লাইগব, কারো টয়লেট ঠিক করা লাইগব। তখন এই টাকাগুলা দি দিব।

সুষম বণ্টন হচ্ছে না, অভিযোগ স্থানীয়দের : আজিজুল্লাহপুর জামে মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কিল্লারহাট। পাশাপাশি গ্রাম শ্যামপুর ও লালানগর।

এসব গ্রামে দিনমজুর অনেক, যাদের ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। প্রায় ১২ দিন ধরে বন্যার পানিতে আটকে তাদের করুণ দশা। এ এলাকাগুলোতে ত্রাণের গাড়ি গেলেও অভিযোগ উঠেছে, কেউ পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না।

আজিজুল্লাহপুর গ্রামের ইকবাল হোসেন মামুনের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চারমুই চাইরটা গাড়ি ঢুকি যাইব, প্রত্যেকটা লোকে পাইব। তোরা কিছু পাইলেই পূব শ্যামপুর, পূব শ্যামপুর আর মোল্লা বাইত। এ ছাড়া তোরা কিছু বুঝসনা। এইডা কি? হেমুই বন্যা উইঠছে। দহিনমুই আর পশ্চিমমুই বন্যা উডেনো?

আরে জেলেপাড়ার মানুষ খুব কষ্টে আছে। পশ্চিমমুই কেউ হাইছে, কিন্তু শতকরা ৬০ ফ্যামিলি পায়নো। এক্কেরে যে পায়নো এইডানো। কয়েকজন আই ঝাপ-ঝুপ দি যা নিছে নিছে। আর বাকিরা খুব কষ্টে আছে, অনেক বেশি কষ্টে আছে।

এলাকার মানুষের অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, তারা দৈনিক আনি দৈনিক খায়। কিছু একটা আছে শ্যামপুরে, নয় সব শ্যামপুরে লই যাইবো কিল্লাই? তরাদরি যেতারা কইরবার, হেতেরা করে। কিন্তু হেতারা পূব শ্যামপুর ছাড়া কিছু বুঝেনো। এইযে মালগুলা ঢুকাইতেছে, পূব শ্যামপুর যথেষ্ট মাল ঢুকছে, আর কোনদিকে এতো ঢুকেনো।

বিত্তবানরাও ত্রাণের প্যাকেট নিচ্ছে জানিয়ে মামুন বলেন, যাদের কোনো অভাব নাই, তাদেরও দেখলাম এখান থেইকা একটা প্যাকেট পাওয়ার জন্য হাহাকার ছিল গতকাইল। মুখ কালা আছিল, প্যাকেট পাইয়া হাসি দিছে। আবার কিছু মানুষ মইধ্যবিত্ত, তারা কয় তাগো লাইগতোনো।

দুই মেয়ে মা ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার অটোচালক নূর হোসেনের। বন্যায় গ্যারেজবন্দি অটোরিকশা দেখিয়ে তিনি বলেন, আইজ ১২-১৪ দিন ধরি অটো বন্ধ। ইনকাম নাই, কোনোরকম খাই না খাই বাঁচি আছি।

দিনমজুর ইমাম হোসেন সুমন বলেন, সবার পাকঘরে বসতঘরে হানি ঢুকি গেছে। বাথরুমের সমস্যা। থাকা কষ্ট, খাডের উপর কোনোরকম রইছে আরকি কেউ কেউ।

দিনের বেলা অনেকেই থাকে, সইন্ধ্যা অইলে চলি যায়। বিভিন্ন উঁচা বিল্ডিং যে যেখানে পারে চলি যায়। আর কয়েকজন উঁচা চকির উপরে থাকে। আমার ভাইয়ের সব ফ্যামিলি চলি গেছে। আমার রাইতে থাকতে হয় বাড়িত একা। সাপ এতো মোটা, ভয়ে লাইট জ্বালাই বসি থাকি।

শ্যামপুরে সব ত্রাণ যাচ্ছে- এমন অভিযোগ উঠলেও নিজেই ঠিকঠাক ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেন এ গ্রামের মনসুরা খাতুন।

তিনি জানান, খাল পার হয়ে অনেকটা ভেতরে তার বাড়ি যেতে হয় বলে সেখানে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। কাছাকাছি আর যারা দিচ্ছে, তাদের চেনাজানা লোককে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ তার।

দুই মেয়ে মনসুরা খাতুনের। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, আরেকজন বাড়িতে তার সঙ্গেই থাকেন। কিছু পাওয়ার আশায় দিনমনির হাঁটের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি।

কোথায় যাচ্ছেন- জিজ্ঞেস করতেই বললেন, কিছু হামুনি খাইতাম?

বন্যার মধ্যে কিছু পেয়েছেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কিছু শুকনা জিনিস হাইছি, আর হেদিন দুই কেজির মতোন চাল হাইছি। এগুন দি আর কয়দিন চলে? আমার বাইত যাইতে বুক সমান হানি, তাই কেউ যায় না।

মো. মোস্তফা নামে কিল্লারহাটের এক বাসিন্দা জানান, হুটলার টাল লই কাইল একটা ট্রাগ গেছে সামনের দিকে। আমরা কিছু হাইনো। ডেইলি যাইতেছে, কই যায় কারে দেয়, আল্লাহ জানে।

ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত রিয়াজ উদ্দীন নামে এক যুবক বলেন, আমাদের এখানে অবস্থা অনেক খারাপ। কোথাও কোথাও যাইতে বুক সমান পানি। আমরা অনেকেরে অত বেশি ত্রাণ পৌঁছাই দিতাম পাইরতেছি না। যা আমাদের সামর্থে মিলাইতেছে, তা আমরা দিতেছি। এখানে মেডিক্যাল টিমও অতো বেশি আইসতেছে না। সবকিছু মিলাই খারাপ।

মুছাপুরের দিকে একটি খাল ভরাট করে বসবাস করছে প্রায় ৮০০ পরিবার। এর আগে তাদের উচ্ছেদ করতে গেলেও স্থানীয়দের বাঁধাও ফিরে আসতে হয়েছে। খালটি থাকলে এ এলাকায় বন্যার পানি সহজেই নেমে যেত বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা।

আজিজুল্লাহপুর জামে মসজিদের ইমাম হোসেন সুমন বলেন, শুনছি খাল উদ্ধারে ছাত্ররা আল্টিমেটাম দিছে। খালটা ফ্রি থাইকলে হানি এতদিন আটকি থাইকতনো।

এমটিআই

Link copied!