‘মাঝে মাঝে রাস্তা মাইপ্পা যায়, কেউ আর রাস্তা ভালো করে দেয় না’

  • তাপস মাহমুদ, বরগুনা | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২৪, ১১:৫২ এএম
‘মাঝে মাঝে রাস্তা মাইপ্পা যায়, কেউ আর রাস্তা ভালো করে দেয় না’

ছবি : প্রতিনিধি

বরগুনা: সাগর উপকূলীয় জেলা বরগুনার বিভিন্ন সড়কের খানাখন্দভরা সড়কে চলতে চলতে নাভিশ্বাস উঠে গেছে এই এলাকার বসবাস করা লক্ষ লক্ষ মানুষের। এমন অবস্থা দাড়িয়েছে যেন মোরা রাস্তায় চলাচল করে উপভোগ করি সাগরের ঢেউয়ের। রাস্তায় গাড়ি চালালে মনে হয় সমুদ্রের ঢেউয়ে পড়েছে। কত এমপি পরিবর্তন হয়, চেয়ারম্যান পরিবর্তন হয়, মোগো কপাল আর পরিবর্তন হয় না। মাঝে মাঝে রাস্তা মাইপ্পা যায়, কেউ আর রাস্তা ভালো করে দেয় না। ক্ষোভ প্রকাশ করে কথা গুলো বলেছিলেন সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের উরবুনিয়া গ্রামের সালাম হাওলাদার। 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এলজিইডি’র আওতায় বরগুনা জেলায় ৪শ’ ৭৭ কিলোমিটার সড়ক চলাচলে অনুউপযোগী হয়ে পড়েছে। সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পিচ-খোয়া উঠে গিয়ে গর্তে পরিণত হয়েছে। এসব জায়গায় সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে মানুষ এবং যানবাহন। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার রোগী এবং স্কুলগামী শিশুরা। এসব সড়কে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। পণ্য পরিবহন তো দূরের কথা মানুষ চলাচলেরই অনুপযোগী হয়ে পড়েছে অধিকাংশ সড়কগুলোতে। বরগুনাবাসীর সর্বত্র দাবী দ্রুত মেরামতের দাবি খানাখন্দে জর্জরিত এসকল সড়কের। 

তবে বরগুনা এলজিইডি কর্তৃপক্ষ বলছেন, বরাদ্দ সংকটে মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না এসব ঝুঁকিপূর্ণ সড়কের। বরগুনা জেলার ৬টি উপজেলায় এলজিইডি’র (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর) আওতায় ৬ হাজার ৩৪৩ কিলোমিটার কাঁচাপাকা সড়ক রয়েছে। যার মধ্যে এক হাজার ৪৩০ কিলোমিটার কার্পেটিং, ৫০৮ কিলোমিটার আধাপাকা এবং ৪ হাজার ৪০৫ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক। এক হাজার ৪৩০ কিলোমিটার কার্পেটিং সড়কের মধ্যে উপজেলা সড়ক ৪০১ কিলোমিটার, ইউনিয়ন সড়ক ৪২২ কিলোমিটার, গ্রাম সড়ক ৬০৭ কিলেমিটার।

এলজিইডি কর্তৃপক্ষ বলছেন, পাকা সড়কে প্রতি অর্থবছরে অন্তত তিনের একাংশ মেরামত করা প্রয়োজন হয়ে দাড়ায়। সে অনুযায়ী এক হাজার ৪৩০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে এ অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ৪৭৭ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করতে হবে। তাদের হিসেবে (এলজিইডি) প্রতি কিলোমিটার সড়ক মেরামত করতে ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। সে অনুযায়ী ৪৭৭ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করতে ব্যয় হবে ৩শ’ ১০ কোটি ৫ লাখ টাকা। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরগুনা জেলায় সড়ক মেরামতের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। সেখান থেকে এলসিএস মহিলা কর্মী, এমএমটি ও কেরিড ওভার বাবদ বাদ যাবে ১০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সর্বসাকূল্যে সড়ক মেরামতে ব্যয় করা যাবে মাত্র ২৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। যা প্রয়োজনের তুলনায় ১২ দশমিক ৫৯ ভাগ মাত্র। তাই এ অর্থবছরে জেলার ৪৭৭ কিলোমিটার খানাখন্দ সড়কের মাত্র ৩৮ কিলোমিটার মেরামত করা সম্ভব হবে। বাকী ৪শ’ ৩৯ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্থ সড়ক অর্থের অভাবে মেরামত করা সম্ভব হবে না। 

এব্যাপারে বরগুনার সচেতন মহলের দাবী ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের হিসাব এলজিইডি কর্তৃপক্ষের। বাস্তবে এর চেয়েও বেশি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্থ সড়ক রয়েছে বরগুনা জেলায় এমনটা দাবী তাদের। জেলায় এমনো এলাকা রয়েছে যেখানে এলজিইডি কোন কাজই করে নাই। যদি এর অনেকটা ছিল রাজনৈতিক নগ্ন হস্তক্ষেপ।  

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সদর উপজেলার লাকুরতলা-ফুলঝুড়ি ভায়া বাওয়ালকর ১৬ কিলোমিটার সড়ক। গত আট দশ বছর ধরে  পরে আছে খানাখন্দ অবস্থায়। যার কিছু অংশ (৩ কিলোমিটার) গত বছর পূর্বে নামমাত্র মেরামত হলেও এখনো সংস্কার হয়নি বেশিরভাগ সড়ক। এ সড়কটি দিয়ে কয়েকটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ বরগুনায় যাতায়াতকারী হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত। কিন্তু বর্তমানে সড়কটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। যেখানে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। আর সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে প্রসূতি মা, রোগী ও নারী-শিশুরা। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে এসকল সড়কে ধুলো সৃষ্টি হয়ে ইটের লাল রংয়ের ধুলোতে নাকাল থাকে এলাকাবাসী। শ্বাসকষ্ট সহ নানান রোগে ভুগতে থাকে শিশু, বৃদ্ধ সহ এলাকাবাসী। 

একই অবস্থা সদর উপজেলার বরগুনা-চালিতাতলী, বরগুনা-নিশানবাড়িয়া, বরগুনা-কালিরতবক, পরীরখাল-রাখাইনপাড়া, ডৌয়াতলা-আয়লা বাজার, বৈকালিন বাজার-আয়লা। আমতলী উপজেলার মানিকঝুড়ি-কচুপাত্রা, ঘোপখালী-সোমবাড়িয়া বাজার, গুলিশাখালী,হলদিয়া ইউনিয়নের মানুষ। এই এলাকার মধ্য বরগুনার বদরখালী, আয়লা পাতাকাটা ও আমতলীর আমতলী সদর ইউনিয়নের সড়কের অবস্থা মারাত্মক রকমের খারাপ। 

তালতলী উপজেলার ছোটবগী-তালতলী, পঁচাকোড়ালীয়া-চান্দখালী, তালতলী-সোনাকাটা, ছোটবগী-কড়ইবাড়িয়া, বামনা উপজেলার রামনা-খোলপটুয়াসহ একাধিক সড়কে খানাখন্দ হয়ে চলাচল অনুপযোগী হয়ে আছে। এসব সড়কে যানবাহন চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হতে হয় বলে জানান স্থানীয়রা।

খাজুরতলা এলাকার অটো চালক নাঈম বলেন, লাকুরতলা-ফুলঝুড়ি রাস্তা দিয়া প্রত্যেক দিন হাজার হাজার মানুষ চলাচল করে। অটো-রিক্সায় যাইতে গিয়া প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকের হাত-পাও ভাইঙ্গা হাসপাতালে যাওয়া লাগছে। অটো-রিক্সা প্রায়ই ভেঙ্গে যায়। গর্ভবতী মা এই সড়ক দিয়া নিয়ে গেলে হাসপাতালে যাওয়া লাগে না, রাস্তায়ই সন্তান প্রসাব করবে। তাই সড়কটি দ্রুত মেরামতের দাবি নাঈমের।

তালতলী উপজেলার পচাঁকোড়ালিয়া গ্রামের মো: বেলাল বলেন, আমার বাড়ির সামনের সড়কটি দীর্ঘ্যদিন ধরে খানাখন্দ অবস্থায় পরে আছে। এখান থেকে যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা মানুষ হাটতেই কষ্ট হয়। তিনি আরও বলেন, এ সড়কটি মেরামতের জন্য এলজিইডি কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার গেলেও কোন কার্যকরী পদক্ষেপ হয়নি। 

বরগুনার সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা বলেন, বরগুনা জেলার সড়ক মেরামতে বরাদ্দ অনেক কম। যে কারনে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ যতই মেরামত করুক, ক্ষতিগ্রস্থ সড়ক কমছেনা। তাই সম বন্টনের পাশাপাশি উপকূলীয় জেলা হিসেবে সড়ক মেরামতে বেশি বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান তাদের। 

বরগুনা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মেহেদী হাসান খান বলেন, আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৮০ কোটি টাকার স্কিম তৈরী করে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। যদি সে অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া যায় তাহলে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যতগুলো সম্ভব সড়ক মেরামত করা হবে। অন্যথায় যা বরাদ্দ পাওয়া গেছে সেই টাকা দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সড়ক মেরামতের কাজ করা হবে।  

এসআই/এম

Link copied!