রাঙ্গামাটি: দেশের অন্যান্য জেলাসমূহ অপেক্ষা অনেকাংশে পিছিয়ে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলো। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া পাহাড়ি বাঙালির জীবন জীবিকাকে বর্তমান সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমুখি কার্যক্রমের মাধ্যমে এই অঞ্চলের দৃশ্যপট পাল্টে দিয়ে আমূল পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছে।
শিক্ষা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে দুর্গম এলাকার সড়কসমূহে যোগাযোগের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা এসেছে।
পার্বত্য অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য যোগাযোগ নিরবিচ্ছন্ন রাখতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৯ সন থেকে (ট্রানজিট রোড) সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজের সূচনা করেন। এই সীমান্ত সড়ককে ঘিরে এই অঞ্চলের মানুষ নতুনভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, তথ্য-প্রযুক্তি, পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং জীবনের ধারার ব্যাপক পরিবর্তনে বর্তমান নির্মাণাধীন সীমান্ত সড়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে স্থানীয় প্রত্যাশা করছে স্থানীয় জনসাধারণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় পার্বত্য চট্টগ্রামে তথা (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান) জেলায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কারণে পাহাড়ি জনপদগুলোতে ইতোমধ্যেই আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এই ট্রানজিট সড়ক নির্মাণের কারণে ভারত ও বাংলাদেশের স্থলপথে যোগাযোগের একটি মাইলফলক স্পর্শ করেছে। সড়কটি নির্মানের ফলে পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের যেমন প্রসার ঘটবে তেমনি যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পর্যটন শিল্পেরও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে বলে মনে করছেন সুশীল সমাজ।
চলমান কাজ শেষ হওয়ার পর পিছিয়ে থাকা অঞ্চলটি এক সমৃদ্ধশালী অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে মনে করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্ম কর্মকর্তাগণ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনস্থ ১৬, ২০ এবং এডহক ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন এই সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ পরিচালনা করছে। এই নির্মাণাধীন সীমান্ত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য হবে ১০৩৬ কিলোমিটার।
এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে একনেকে ৩১৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কাজের মধ্যে ৯৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ ইতোমধে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া এই বছরে প্রকল্পটির আরও ১৩২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে, যা চলতি বছরের এপ্রিলে শেষ হবে। অবশিষ্ট ৯০ কিলোমিটার কাজ ২০২৪ সালের জুন মাসে সম্পন্ন করা হবে বলেও জানানো হয়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার রাজস্থলী উপজেলার মিতিঙ্গাছড়ি এলাকার বাসিন্দা ও ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের ১,২,৩, নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্যা রসনাত্রী ত্রিপুরা বলেন, ‘সীমান্ত সড়ক হওয়ার আগে কেউ অসুস্থ হলে রোগীকে এখান থেকে হাসপাতালে নিতে খুবই কষ্ট করতে হতো। বর্তমানে আমরা দুই ঘণ্টার মধ্যে রাজস্থলী সদর হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে যেতে পারি।’
পার্শ্ববর্তী গাইন্দ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পুচিংমং মারমা বলেন, রাজস্থলী উপজেলার মধ্যে সীমান্ত সড়ক হওয়ায় আমরা অত্যন্ত খুশি। এক সময় রাজস্থলী উপজেলা তেমন পরিচিতি লাভ করেনি। এখন সীমান্ত সড়কের ফলে রাজস্থলীর প্রত্যেকটা মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে।
ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের মিতিঙ্গা ছড়ি গ্রাম প্রধান, (কারবারী) পূন্য চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, আমাদের এ মিতিঙ্গাছড়ি থেকে রাজস্থলী সদরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। সীমান্ত সড়ক হওয়ার ফলে সেই দূরত্বে আমাদের অনেকাংশে কমে গেছে। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা রাজস্থলী সদর থেকে শুরু করে চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান ও চট্টগ্রাম এমনকি রাজধানীতে পৌঁছে যেতে পারি।
রাজস্থলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উবাচ মারমা বলেন, সীমান্ত সড়ক হওয়ার কারণে দুর্গম এলাকার জনগণ বর্তমানে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিসপত্র রাজস্থলী উপজেলা সদরে এনে বিক্রি করতে পারছে।
শুধুমাত্র রাজস্থলী উপজেলা নয় জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি উপজেলার মানুষও এ সড়কের ফলে উপকৃত হবে। ভবিষ্যতে এই সড়ক পর্যটনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা জোরদার করতে এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সীমান্ত সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে সীমান্ত সড়ক নির্মাণে সেনাবাহিনী নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কাজ করছে।
২৬ ইঞ্জিনিয়ার্স কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম মুহায়মিন বিল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের সীমান্তের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদান করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরলস প্রচেষ্টায় সীমান্ত সড়ক প্রকল্পটি গুনগত মান নিশ্চিত করে সম্পন্ন করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রধানের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২৪ সালের মাঝামাঝি প্রকল্পটি শেষ করা হবে। প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ এবং এ প্রকল্পে নিয়োজিত সেনা সদস্যদের মনোবল উন্নত করার জন্য সেনাবাহিনী প্রধান ইতোমধ্যে এই অঞ্চল পরিদর্শনে আসেন।
তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকি। প্রথমত প্রকল্পটি অনেক দুর্গম এলাকাতে হওয়ায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়াতে সেনাদের কাজ করতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখে পড়তে হয়। এছাড়াও এখানে নির্মাণ সামগ্রী এবং শ্রমিকেরও সঙ্কট রয়েছে। এরপরও এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে সেনাবাহিনী সঠিক সময়ে প্রকল্প সম্পন্ন করবে। সীমান্ত সড়কের পুরো কাজ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়ে গেলে পার্বত্য অঞ্চল এক আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে উঠবে। দেশের অর্থনীতিতে পার্বত্য অঞ্চলে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
সোনালীনিউজ/এম
আপনার মতামত লিখুন :