মুন্সীগঞ্জ : ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে পদ্মা নদী উত্তাল হয়ে পড়েছে। এর ফলে নদী ভাঙনের আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন লৌহজংয়ের হাজারো পরিবার। ঢেউয়ের তোড়ে নদী ভাঙন রোধে ফেলা জিও ব্যাগ সরে যাচ্ছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।
এরমধ্যে উপজেলার সিংহেরহাটির একই গ্রামের বাসিন্দা কালাম ও মোস্তফার ভিটেবাড়ি গতরাতে পদ্মার বুকে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু এ এলাকার নয় উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী শিমুলিয়া, খড়িয়া, দক্ষিণ হলদিয়া, সিংহেরহাটি, তেউটিয়া, রাউৎগাঁও, বাগেরবাড়ি, সুন্দিসার, ডহরী এলাকায় তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে ফেলে রাখা জিও ব্যাগ তলিয়ে মাটি ভেঙে যাচ্ছে।
২০২১ সালে শুরু হওয়া বাঁধ নির্মাণ চলাকালে রিমালে এ ভাঙন আতঙ্ক জাগাচ্ছে নদীতীরবর্তী হাজারো মানুষকে। অনেকেই ঝড়ের রাতে বাড়িঘর ভাঙনের আশঙ্কায় সতর্কতা অবলম্বন করছেন। কেউ কেউ আবার কাছাকাছি আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এবারের ভাঙন বর্ষাকালের আগেই আতঙ্ক জাগাচ্ছে। ধীরগতিতে কাজ হওয়ায় এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ।
লৌহজং উপজেলার খড়িয়া থেকে ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দিঘিরপাড় পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় ২০২১ সালে। ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ৪৫ শতাংশ। আর এসব বিষয় নিশ্চিত করেছেন মুন্সীগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ড।
কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ব্লক নির্মাণের কাজ হয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। শুরুতে লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া থেকে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দীঘিরপাড় পর্যন্ত ৯.১ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা নদীর তীর রক্ষায় ব্যয় ধরা হয় ৪৪৬ কোটি টাকা। পরে আরও ৬ কিলোমিটার তীরে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর জন্য আরও ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ বেশি দেওয়া হয়।
ভাঙনের মুখে নদীতীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে রয়েছে লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া বাজার, কনকসার বাজার, ব্রাহ্মণগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়, লৌহজং পুরাতন থানা ভবন, ঘোড়দৌড় বাজার, কলমা ইউনিয়নের চটকিবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টঙ্গীবাড়ি উপজেলার হাসাইল-বানারী বাজার ও দীঘিরপাড় বাজার।
গত শতাব্দীর নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় এক দশক মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলা দুটির প্রায় ৪০টি গ্রাম পদ্মা নদীতে বিলীন হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি, ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব ও বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পদ্মার তীর সংরক্ষণের খবরে নদীতীরবর্তী মানুষ ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।
ঝাউটিয়া গ্রামের প্রদীপ দাস জানান, আড়াই দশক আগে আমাদের বাড়ি থেকে পদ্মা নদী প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ছিল। এখন সে নদী একেবারে বাড়ির কাছে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন ভাঙন শুরু হয়ে যায়। নদী শাসনের খবর শুনে ভালো লেগেছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মাত্র অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
পদ্মার ভাঙনের কবলে থাকা ১২০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মণগাঁও বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ আসলাম বলেন, আমি এ বিদ্যালয়ের এক সময়ের ছাত্র। এখানেই এখন শিক্ষকতা করছি। ছাত্র অবস্থায় দেখেছি বিদ্যালয় থেকে পদ্মা নদী ছিল কয়েক কিলোমিটার দূরে। আর এখন একেবারে ভাঙনের মুখে। তাছাড়া নদীর পাড় থেকে ৩০ মিটার দূরত্বে নির্মাণ করা হচ্ছে বিদ্যালয়ের নবনির্মিত ৪ তলা ভবন।
গাওদিয়া গ্রামের কাজী বাবুল বলেন, পদ্মার ভাঙনে দুই দশক আগে বসতবাড়ি, জমাজমি হারিয়ে বর্তমানের স্থানে আছি। এখান থেকে নদী মাত্র ২০০ মিটার দূরে। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না। নদী শাসনের কাজ শেষ হলেই অনেক খুশি আমরা। তিনি আরও বলেন, শুকনো মৌসুমে কাজ হয়েছে সামান্যই। আমরা পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এ প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন জানান, ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতার জিও ব্যাগ ফেলছি। সে আমাদের পুরোপুরি তদারকি রয়েছে।
তিনি আরও জানান, স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হয়ে গেলে লৌহজংবাসীর আতঙ্কে দিন শেষ হয়ে যাবে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দ্রুত গতিতে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছি।
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :