পিএসসির গাড়িচালক আবেদ

হয়েছিলেন ‘সৈয়দ’, হতে চেয়েছিলেন চেয়ারম্যান

  • মাদারীপুর প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২৪, ০৯:৪৭ এএম
হয়েছিলেন ‘সৈয়দ’,  হতে চেয়েছিলেন চেয়ারম্যান

মাদারীপুর : প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীর জীবন দারিদ্র্যের মধ্যে শুরু হলেও বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলার পর নিজের পদবি পাল্টে ‘সৈয়দ’ হয়েছিলেন; মাদারীপুরের ডসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে প্রচারও চালাচ্ছিলেন।

অভিযোগ আছে, নিজে জীবনে কোনোদিন আওয়ামী লীগ না করলেও উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রচারের পোস্টারে ব্যবহার করেছিলেন দলের নেতাদের ছবি। নবগঠিত ডাসার উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের তফসিল এখনও হয়নি। তবে আবেদের ছেলে সিয়াম ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছিলেন।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আবেদ আলীর পরিবার ছিল খুবই দরিদ্র। পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজেকে আবাসন খাতের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি পরিচয় দিয়ে এলাকায় দান-খয়রাতও করতেন।

আয়েশি জীবন-যাপনের পাশাপাশি চলতেন দামি গাড়িতে। আগে কিছু না থাকলেও সম্প্রতি এলাকায় গড়ে তুলেছেন বিশাল বাড়ি, খামার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

ডাসার প্রেসক্লাবের সভাপতি সৈয়দ রাকিবুল ইসলাম বলেন, আবেদ আলী মীর ও তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম গত এক-দেড় বছর ধরে এলাকায় উপজেলা নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছেন। যা আমাদের চোখে পড়েছে। এর আগে তাদের ওভাবে ডাসার উপজেলার মানুষ চিনত না।

তবে নিজ গ্রাম পশ্চিম বোতলায় তিনি একটি তিনতলা ভবন, মসজিদ ও একটি গরুর ফার্ম নির্মাণ করার পরে আমাদের নজরে আসে। এবং তখন তার বিরুদ্ধে সড়ক ও জনপথের সরকারি জমি দখল করে গরুর ফার্ম নির্মাণের অভিযোগ পাই। তা নিয়ে আমরা সংবাদপত্রে খবর পরিবেশন করি। এরপর উপজেলা প্রশাসন তা ভেঙে দেয়।

রাকিবুল বলেন, এতে বোঝা যায়, তিনি আসলে একজন প্রতারক। তিনি প্রশ্ন ফাঁস করে ডাসারের বদনাম করেছেন। আমরা তার শাস্তি দাবি করছি।

আবেদ আলীর ছোট ভাই সফেদ আলী মীর পেশায় অটোরিকশার চালক। যদিও বড় ভাইয়ের সঙ্গে তার পরিবারের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন তিনি।

সফেদ আলী মীর বলেন, ভাই ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করেছেন। পরে ড্রাইভারের চাকরি করেন। কিন্তু ব্যবসা শুরু করার পরে আবেদ আলী আর চাকরি করেন না।

সে যা করেছে ব্যবসা-বাণিজ্য করেই করেছে। তার বিয়ের পর থেকে আমাদের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই।

একটি চক্র প্রায় এক যুগ ধরে পিএসসির অধীনে বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত বলে ছয়জনের ছবিসহ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রোববার প্রচারিত হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে।

এরপরেই সিআইডি তদন্ত করে ওই ছয়জন ছাড়াও অন্য যাদের নাম পেয়েছে অভিযানে নেমে আবেদ আলী, তার ছেলে সিয়ামসহ মোট ১৭ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় পল্টন থানায় একটি মামলা হয়। যার তদন্ত সিআইডি করছে।

এর মধ্যে পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীসহ ছয়জন মঙ্গলবার ঢাকার একটি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আবেদ আলী ওরফে জীবন ডাসার উপজেলার পশ্চিম বেতলা গ্রামের মৃত আব্দুর রহমান মীরের ছেলে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে আবেদ আলী মেজ।

আব্দুর রহমান মীরের বড় ছেলে জবেদ আলী কৃষিকাজ করেন। ছোট ছেলে সাবেদ আলী এলাকায় অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

স্থানীয়রা বলেন, আবেদ খুব অল্প বয়সে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে দিনমজুরি শুরু করেন। পরে তিনি গাড়ি চালানো শিখে পিএসসিতে চাকরি নেন। এরপর থেকে তার বিত্ত-বৈভব বাড়তে থাকে।

আবেদের পরিবারের পদবি ‘মীর’। কিন্তু বিত্ত-বৈভবে ফুলেফেঁপে উঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পদবি পাল্টে ‘সৈয়দ’ হয়ে যান। এলাকায় বাবা-ছেলে মিলে দান-খয়রাত করতেন।

আবেদ আলীর পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারের খবরে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। তার ছেলে সিয়ামকে এরই মধ্যে উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতির পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

আবেদ আলীর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি তিনতলা বিলাসবহুল বাড়িতে আবেদ আলী ও ছেলে সিয়ামের ছবি সম্বলিত বিশাল ব্যানার ঝুলছে। বাড়ির পাশে করেছেন মসজিদ।

এ ছাড়া তিনি রাস্তার পাশে সরকারি জায়গা দখল করে গরুর খামার ও মার্কেট তৈরি করছেন বলেও জানান স্থানীয়রা।

এ ছাড়া পান্তাপাড়া ও পূর্ব বোতলা গ্রামের তিনি অনেক জমি কিনেছেন বলেও জানান এলাকার মানুষজন।

তারা বলেন, আবেদ আলীর ছেলে সিয়াম কোরবানির ঈদে দামি গাড়িতে চড়ে বাড়ি এসে ১০০ জনকে এক কেজি করে মাংস দিয়েছেন। পরে সেই ভিডিও শেয়ার করেন নিজের ফেইসবুকে। সিয়াম পড়েছেন ভারতের শিলংয়ে এবং দেশের একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নিজেদের প্রভাব জাহির করার জন্য বড় বড় নেতা ও আমলাদের সঙ্গে ছবি তুলেন বাবা-ছেলে দুজনেই। সেসব ছবি ফেইসবুকে ব্যাপকভাবে প্রচার করতেন।

পশ্চিম বেতলা গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রব বলেন, আবেদ আলী মীরের বাবা-মা একসময় খয়রাত করে চলতেন। এখন আবেদ আলী অনেক বড় হয়েছেন। অর্থবিত্ত হয়েছে। এলাকায় অনেক দান-খয়রাত দেন। কিন্তু কিভাবে তিনি এত টাকা-পয়সা করেছেন সে সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানেন না।

ডাসার উপজেলা সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জলিল বেপারী বলেন, “আবেদ আলী তার নির্বাচনি প্রচারে পোস্টারে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি ছাপিয়ে অন্যায় করেছেন। কারণ তাকে কখনও ডাসারে এসে কোনোদিন আওয়ামী লীগ করতে দেখিনি। আমি তো ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

তার এই কর্মকাণ্ডে এখন আমরা বিব্রত। তার অবৈধ কালো টাকা দিয়ে সে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। এখন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে তবে তা পজেটিভ নয়; নেগেটিভভাবে। আমি তার শাস্তি দাবি করছি।

এ ব্যাপারে মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, যারা অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জন করেছেন তাদের নিয়ে সচেতন মহলের প্রশ্ন তোলা উচিত। সরকারের উচিত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। প্রশ্ন ফাঁস করে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করার কারণেও এদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক মাদারীপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে কেউ অভিযোগ দিলে আমরা প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করব।

এমটিআই

Link copied!