কোটা সংস্কার আন্দোলন 

রাজশাহীতে পুলিশসহ আহত অর্ধশতাধিক, নাশকতায় রাবি’র ক্ষতি ৪ কোটি টাকা

  • সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২৪, ০১:১৬ পিএম
রাজশাহীতে পুলিশসহ আহত অর্ধশতাধিক, নাশকতায় রাবি’র ক্ষতি ৪ কোটি টাকা

রাজশাহী: সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাজশাহীতে গত ১৬ থেকে ১৯ জুলাই দেশব্যাপী আন্দোলন ও সংঘর্ষে শিক্ষার্থী, পুলিশসহ রাজশাহীতে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। তবে রাজশাহীতে এসময় কোন প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নাশকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) হলগুলোতে তাণ্ডব চালিয়েছে। এতে রাবির ১০টি হলের ১৫৮টি কক্ষে তান্ডব চালানো হয়েছে। আগুন দেয়া হয়েছে একটি হলে। পুড়ানো হয়েছে ১৯টি মোটরসাইকেল। সব মিলিয়ে নাশকতার দিনগুলোতে চলানো তাণ্ডবে রাবি’র ৪ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে । আবাসিক হলে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

রাবি সূত্র জানায়, আবাসিক হলে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক এসএম একরাম উল্যাহকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হোসেন বকুলকে। কমিটিকে আট সপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য। ঘটনার বিবরণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং কী করণীয় (সুপারিশ) সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যলয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার জানান, যে সহিংসতা ঘটে গেছে এটা খুবই দুঃখজনক। শুরুতে যে আন্দোলন হয়েছিলো কোটা সংস্কারের দাবিতে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিলো। কিন্তু পরে বহিরাগতরা ঢুকে জ্বালাও-পোড়াও করলো ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীরা তাকে ও শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করেননি। বহিরাগতরা রাবিতে প্রবেশ করতে শুরু করে আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে। বড় ধরনের নাশকতা হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই তারা বাধ্য হয়ে বাইরে সংবাদ পাঠায় ও যৌথ বাহিনী এসে উদ্ধার করে।

উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার আরও বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টা আগে নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও হলগুলোকে বসবাসের উপযোগী করতে হবে। বেশকিছু হল এমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে কেউ দেখলে তার মনে আঘাত লাগবে। তাই আমরা চাইনা যে শিক্ষার্থীরা এসে এসব দেখুক। আমরা এসব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি।

ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, এদিন শিক্ষার্থীরা আমাদের অবরুদ্ধ করেননি। আমরা লক্ষ্য করলাম বাইরে থেকে প্রচুর বহিরাগত সন্ত্রাসী অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হুইছেল বাজিয়ে ঢুকতে শুরু করলো। তারা প্রশাসন ভবনে তালা দিয়ে ইলেকট্রিসিটির লাইন কেটে, জেনারেটর বিস্ফোরণের চেষ্টা করে। এতে আমার সাথে থাকা প্রায় অর্ধশত শিক্ষক এবং প্রায় শতাধিক কর্মচারী অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তখন আমরা বুঝতে পারলাম তারা নাশকতা করবে। এরপর আমরা বাধ্য হয়ে খবর পাঠালে এখানে থাকা যেীথ বাহিনী আমাদের উদ্ধার করেন।

উপাচার্য গোলাম সাব্বির বলেন, এবার সন্ত্রাসীরা যে আকারে এসেছে তাদের যে চেহারা আমরা দেখেছি তা আগামীর জন্য খুব আশঙ্খাজনক। সবাইকে অনুরোধ করবো শান্ত হতে। এসকল বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবতে হবে তারা কিভাবে এগোতে চাই। কারণ, বিশ্ববিদ্যলয় মানেই এগিয়ে যাওয়া। আমরা একদিন যদি থেমে থাকি তাহলে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের যেতে হবে বহুদূর।

এদিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে ডাকা ‌‘কমপ্লিট শাটডাউন’ চলাকালে ১৮ জুলাই  বৃহস্পতিবার পৃথক পৃথক স্থানে এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মী ও পুলিশের সাথে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে নগরীর নিউ মার্কেট এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিলে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে মহিলা কলেজের সামনে আসলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে শিক্ষার্থীদের সাথে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়। 

এসময়  আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পুলিশের গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এছাড়া পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এসময় পুলিশের অন্য সদস্যরা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়। এছাড়া, তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কয়েক রাউন্ট রাবার বুলেট ও টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। প্রায় ৩০ মিনিট চলা এই সংঘর্ষে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এসময় পুলিশের দুই সদস্যসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন। আহতদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত দুই পুলিশ সদস্য হলেন, রাজশাহী নগরীর শিরোইল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শাহাদৎ হোসেন ও রাজশাহী জেলা পুলিশ লাইনে কর্মরত মো. আলাউদ্দিন।

এর আগে, বেলা সোয়া ১১টার দিকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী রাজশাহীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট এলাকায় অবস্থান নেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরাও সেখানে গিয়ে জড়ো হন। একপর্যায়ে তারা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এসময় বেশ কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটলে পুরো সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট এলাকায় উত্তেজনা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের পর আহত অবস্থায় অন্তত পাঁচজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

রামেক হাসপাতাল পুলিশ বক্স সূত্রে জানা যায়, আহত পাঁচজনের মধ্যে একজন নগরীর শাহমখদুম কলেজের ছাত্র। তাঁর ঘাড়ে চাপাতির কোপ লেগেছে। শহরের সাহেববাজার এলাকায় সংঘর্ষের সময় আহত হন তিনি। এই এলাকায় বাজারের একজন ডাল ব্যবসায়ী আহত হয়েছেন। শহরের ভুবনমোহন পার্ক এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্রলীগের এক কর্মী আহত হয়েছেন। রাণীবাজারে আহত হয়েছেন এক যুবলীগকর্মী। এ ছাড়া মিয়াপাড়া এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে এক পথচারী আহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে আশপাশের সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের যানবাহন চলাচলও। পথচারী ও সাধারণ মানুষজন প্রাণ ভয়ে দিকবিদিক ছুটোছুটি শুরু করেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর মহানগরের সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট এলাকা দখলে নেয় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আন্দোলনের নামে যদি আর কেউ অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে তাহলে এর জবাব দিতে আমরা প্রস্তুত। তিনি আন্দোলনের নামে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানান। নাহলে এর দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি আন্দোলনের নামে নৈরাজ্যের সৃষ্টির প্রতিবাদে প্রতিদিন নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠ সোডাউন দেন।

রামেক হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. সংকর কুমার বিশ্বাস বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত দুই পুলিশ সদস্য চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়াও আহত ৯ শিক্ষার্থীও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। তাদের মধ্যে নাটোরের এক ছাত্র আছেন। তার গায়ে রাবার বুলেটের ক্ষত রয়েছে। 

এদিকে, এই আন্দোলনকে ঘিরে রাজশাহীতে তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে। সংখ্যায় কম হলেও সকাল থেকেই শহরে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। অফিস-আদালতেও স্বাভাবিক কাজ-কর্ম চলছে। কারফিউ চলাকালে বিভিন্ন দোকানপাট বন্ধ থাকায় জনজীবনে দুর্ভোগ বেড়েছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের চরম সংকটে পড়তে হচ্ছে। 

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) জামিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া রাজশাহীতে আন্দোলনে কোনো প্রভাব রাজশাহীতে পড়েনি। এরপরও পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে। প্রধান প্রধান সড়ক, সরকারি অফিসসহ মহানগর এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

এছাড়া, উদ্ভূত পরিস্থিতি এড়াতে পুরো নগরজুড়ে র্যাব, পুলিশ, বিজিবির যৌথ টহল রয়েছে। কেউ মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমএস

Link copied!