বরগুনা: সাগর উপকূলীয় জেলা বরগুনার বিভিন্ন সড়কের খানাখন্দভরা সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহনগুলো। এতে যত্রতত্র ঘটছে দুর্ঘটনা, হচ্ছে বহু হতহত। বছরের পরে বছর এমন সড়কে চলাচল করতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে গেছে ওই এলাকার বসবাস করা কয়েক লাখ মানুষদের। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন ‘মোরা রাস্তায় চলাচল করে উপভোগ করি সাগরের ঢেউয়ের।’ ফলে খানাখন্দে জর্জরিত এসকল সড়কের দ্রুত মেরামতের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার ৬টি উপজেলায় এলজিইডি’র (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর) আওতায় ছয় হাজার ৩৪৩ কিলোমিটার কাঁচাপাকা সড়ক রয়েছে। যার মধ্যে এক হাজার ৪৩০ কিলোমিটার কার্পেটিং, ৫০৮ কিলোমিটার আধাপাকা এবং চার হাজার ৪০৫ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক। এক হাজার ৪৩০ কিলোমিটার কার্পেটিং সড়কের মধ্যে উপজেলা সড়ক ৪০১ কিলোমিটার, ইউনিয়ন সড়ক ৪২২ কিলোমিটার, গ্রাম্য সড়ক ৬০৭ কিলেমিটার। এর মধ্যে জেলায় ৪শ’৭৭ কিলোমিটার সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সড়কের বিভিন্ন জায়গায় পিচ-খোয়া উঠে গিয়ে গর্তে পরিণত হয়েছে। এসব জায়গায় সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে মানুষ এবং যানবাহন। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার রোগী এবং স্কুলগামী শিশুরা। এসব সড়কে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। পণ্য পরিবহন তো দূরের কথা, মানুষ চলাচলেরই অনুপযোগী হয়ে গেছে অধিকাংশ সড়কগুলো।
এলজিইডি কর্তৃপক্ষ বলছেন, পাকা সড়কে প্রতি অর্থবছরে অন্তত তিনের একাংশ মেরামত করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। সে অনুযায়ী এক হাজার ৪৩০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে এ অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ৪৭৭ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করতে হবে। তাদের হিসেবে (এলজিইডি) প্রতি কিলোমিটার সড়ক মেরামত করতে ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। সে অনুযায়ী ৪৭৭ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করতে ব্যয় হবে ৩শ’১০ কোটি ৫ লাখ টাকা। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরগুনা জেলা সড়ক মেরামতের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। সেখান থেকে এলসিএস মহিলা কর্মী, এমএমটি ও কেরিড ওভার বাবদ বাদ যাবে ১০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সর্বসাকূল্যে সড়ক মেরামতে ব্যয় করা যাবে মাত্র ২৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। যা প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ১২ দশমিক ৫৯ ভাগ। তাই এ অর্থবছরে জেলার ৪৭৭ কিলোমিটার খানাখন্দ সড়কের মাত্র ৩৮ কিলোমিটার মেরামত করা সম্ভব হবে। বাকী ৪শ’৩৯ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্থ সড়ক অর্থের অভাবে মেরামত করা সম্ভব হবে না। মোট কথা, বরাদ্দ সংকটে মেরামত করা সম্ভব হচ্ছেনা এসব ঝুঁকিপূর্ণ সড়কের।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সদর উপজেলার লাকুরতলা- ফুলঝুড়ি ভায়া বাওয়ালকর ১৬ কিলোমিটার সড়কটি গত আট দশ বছর ধরে পরে আছে খানাখন্দ অবস্থায়। যার কিছু অংশ (৩ কিলোমিটার) গত বছর পূর্বে নামমাত্র মেরামত হলেও এখনো সংস্কার হয়নি বেশিরভাগ সড়ক। এ সড়কটি দিয়ে কয়েকটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ বরগুনার হাজার হাজার মানুষ চলাচল করে। কিন্তু বর্তমানে সড়কটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। যেখানে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। আর সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রসূতি মা, রোগী ও নারী-শিশুরা। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে এসকল সড়কে সৃষ্টি হওয়া ধুলোতে নাকাল থাকে এলাকাবাসী। এতে করে শ্বাসকষ্ট সহ নানান রোগে ভুগতে থাকে শিশু, বৃদ্ধ সহ স্থানীয়রা।
একই অবস্থা সদর উপজেলার বরগুনা-চালিতাতলী, বরগুনা- নিশানবাড়িয়া, বরগুনা- কালিরতবক, পরীরখাল- রাখাইনপাড়া, ডৌয়াতলা- আয়লা বাজার, বৈকালিন বাজার- আয়লা সড়কে। ভোগান্তিতে আছে আমতলী উপজেলার মানিকঝুড়ি- কচুপাত্রা, ঘোপখালী- সোমবাড়িয়া বাজার, গুলিশাখালী, হলদিয়া ইউনিয়নের মানুষ। এই এলাকার মধ্য বরগুনার বদরখালী, আয়লা পাতাকাটা ও আমতলীর আমতলী সদর ইউনিয়নের সড়কের অবস্থা মারাত্মক রকমের খারাপ।
তালতলী উপজেলার ছোটবগী- তালতলী, পঁচাকোড়ালীয়া- চান্দখালী, তালতলী- সোনাকাটা, ছোটবগী- কড়ইবাড়িয়া, বামনা উপজেলার রামনা- খোলপটুয়াসহ একাধিক সড়কে খানাখন্দ হয়ে চলাচল অনুপযোগী হয়ে আছে। এসব সড়কে যানবাহন চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হতে হয় বলে জানান স্থানীয়রা।
খাজুরতলা এলাকার অটোচালক নাঈম বলেন, ‘লাকুরতলা- ফুলঝুড়ি রাস্তা দিয়া প্রত্যেক দিন হাজার হাজার মানুষ চলাচল করে। অটোরিক্সায় যাইতে গিয়া প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকের হাত- পাও ভাইঙ্গা হাসপাতালে যাওয়া লাগছে। অটোরিক্সা প্রায়ই ভেঙ্গে যায়। গর্ভবতী মা এই সড়ক দিয়া নিয়ে গেলে হাসপাতালে যাওয়া লাগবে না, রাস্তায়ই সন্তান প্রসাব করবে।’
তালতলী উপজেলার পচাঁকোড়ালিয়া গ্রামের মো: বেলাল বলেন, ‘আমার বাড়ির সামনের সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে খানাখন্দ অবস্থায় পরে আছে। এখান দিয়ে যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা, মানুষের হাঁটতেই কষ্ট হয়। তিনি আরও বলেন, এ সড়কটি মেরামতের জন্য এলজিইডি কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার গেলেও কোন কার্যকরী পদক্ষেপ হয়নি।
বরগুনার সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা বলেন, বরগুনা জেলার সড়ক মেরামতে বরাদ্দ অনেক কম। যে কারনে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ যতই মেরামত করুক, ক্ষতিগ্রস্থ সড়ক কমছে না। তাই সম বন্টনের পাশাপাশি উপকূলীয় জেলা হিসেবে সড়ক মেরামতে বেশি বরাদ্দ দেওয়ার দাবি তাদের।
এ বিষয়ে বরগুনা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মেহেদী হাসান খান বলেন, আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৮০ কোটি টাকার স্কিম তৈরী করে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। যদি সে অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া যায় তাহলে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যতগুলো সম্ভব সড়ক মেরামত করা হবে। অন্যথায় যা বরাদ্দ পাওয়া গেছে সেই টাকা দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সড়ক মেরামতের কাজ করা হবে।
এসএস
আপনার মতামত লিখুন :